২৬ ডিসেম্বর সশস্ত্রবাহিনী : ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভোটকেন্দ্রের বাইরে দায়িত্ব পালন

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ দেশের যে সকল আসনে নির্বাচন হচ্ছে সেখানে সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫ দিনের জন্য সশস্ত্র (সেনা ও নৌ) বাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকবেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের পাশাপাশি নির্বাচনে র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সশস্ত্রবাহিনী ও বিজিবির টিমের সাথে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। ৯ জানুয়ারির পর সেনা সদস্যরা মাঠে থাকবেন কি-না তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে গতকাল শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সেনা মোতায়েনের এ সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে সশস্ত্রবাহিনী কাজ করবে। ৯ জানুয়ারির পর সেনা সদস্যরা মাঠে থাকবেন কি-না তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে বলে জানান তিনি।

সিইসির সভাপতিত্বে গতকাল শুক্রবার এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে চার কমিশনার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান শিকদার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিকেউএ মুসতাক আহমেদ, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার আবু বেলাল মো. শফিউল হক, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে বলে কমিশনকে জানিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এতে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। যেসব এলাকায় ভোট গ্রহণ হবে সেসব এলাকার সেনা মোতায়েনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

২৫ নভেম্বর ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের ৪টি আসনসহ ১৪৬ আসনে ভোটগ্রহণ হবে। চুয়াডাঙ্গার দুটি আসনে দুজন করে প্রার্থী ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। ইতোমধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই সব আসনে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। এতে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৬৭০ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ৩৮৬ জন। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৮ হাজার ১২৩টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৯০ হাজার ৭২৪টি। এ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিতে শুক্রবার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে মাঠ পর্যায়ের অবস্থা, সম্ভাব্য সমস্যা ও করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের বক্তব্যে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। এছাড়া নির্বাচনে বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। একাধিক কর্মকর্তা তাদের বক্তব্যে বলেন, নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা, এলাকাভিত্তিক ভোটারদের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি, কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনপ্রতিনিধিদের উদ্বুদ্ধ করার ওপর জোর দেন তারা।

সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে বলেন, ভোট গ্রহণের আগে যানবাহন চলাচলের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা রাখা হয় তা শিথিল করতে কমিশনকে অনুরোধ জানান। পরে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী বলেন, নির্বাচনে ভোটার বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। বৈঠকে অপর কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলা হয়। আমরা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নির্বাচন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার নির্দেশ দেন তিনি। নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক ও মো. শাহ নেওয়াজ বৈঠকে বক্তব্য দেননি।

প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার তার বক্তব্যে বলেন, শীতকালীন মহড়ার জন্য সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা ২২ জানুয়ারি থেকে মাঠে থাকবে। নির্বাচনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনের অনুরোধ জানান তিনি। তবে কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো সময়ে সেনা সদস্যরা নামতে প্রস্তুত রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। পরে সভাপতির বক্তব্যে সিইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, অন্যান্য নির্বাচনের মতো এবার নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে সেনাসদস্যরা আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত কাজ করবে। অপরাধীদের তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সাথে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করবেন। ৯ জানুয়ারির পর সেনা সদস্যরা মাঠে থাকবে কি-না তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সিইসি বলেন, এটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আমরা আশা করি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা পর্যবেক্ষণে আসবেন। তিনি বলেন, ২২ ডিসেম্বর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারসহ সব ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। ভোটারদের নিরাপত্তা এবং ভোটদানে সহযোগিতা করতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি বলেন, আসন অনুযায়ী কী পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নির্ধারণ করবেন। এছাড়া যেসব প্রার্থী নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র এখনও চূড়ান্ত করিনি। আর কিছু দিন গেলে আমরা এ সংখ্যা পাব।

বৈঠকসূত্রে আরও জানায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে দলমত নির্বিশেষে চিহ্নিত অপরাধী, চাঁদাবাজ, মাস্তান, অস্ত্রবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কারও বিরুদ্ধে হয়রানি বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়। নির্বাচনী এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও আর্মড পুলিশ। ব্যাটালিয়ন আনসার সহযোগী ফোর্স হিসেবে পুলিশের সাথে মোবাইল টিমের দায়িত্বে থাকবে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেন, সে জন্য নিশ্চয়তামূলক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ ইউনিটসমূহ কাজ করবে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং যে কোনো প্রকার অশুভ কার্যকলাপ প্রতিরোধে সজাগ থাকতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবলোকনের জন্য ১ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে একটি সেল খোলা হবে। এ সেল পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ করবে এবং প্রাপ্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্মিলিত বাহিনীকে অবহিত করবে। সভার কার্যপত্র অনুযায়ী প্রতি কেন্দ্রে ৪ জন অস্ত্রধারীসহ ১৫ জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ৫ জন অস্ত্রধারীসহ ১৬ জন দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতি কেন্দ্রে ৪ জন অস্ত্রধারীসহ ১৬ জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ৫ জন অস্ত্রধারীসহ ১৮ জন দায়িত্ব পালন করবেন। পার্বত্য এলাকায় ৬ জন অস্ত্রধারীসহ ১৭ জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ৮ জন অস্ত্রধারীসহ ১৯ জন পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য কাজ করবেন।
নির্বাচন উপলক্ষে আগামী ৪ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি-অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। আগামী ৩ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ৭ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত সারাদেশে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। ২২ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ অস্ত্র বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।