মুফতি হান্নানসহ ৮ জনের ফাঁসি : ৬ জনের যাবজ্জীবন

 

স্টাফ রিপোর্টার: নববর্ষের প্রথম প্রহরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমাহামলার হত্যা মামলায় ১৩ বছর পর হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতিআব্দুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। অপর ছয় আসামিকেযাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো এক বছরেরসশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগসন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ দণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে৫ আসামি পলাতক রয়েছেন।

গতকাল সোমবার বেলা ১২টায় জনাকীর্ণ আদালতে এ রায়ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. রুহুল আমিন। রায়েবলা হয়, এটা কোনো রাজনৈতিক মামলা নয়। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ওআতঙ্ক সৃষ্টি করাসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কলুষিত তথা সংস্কৃতি চর্চাবন্ধ করার জন্যই এ বোমা হামলা চালানো হয়েছিলো।রায় ঘোষণার সময়নয় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ে আসামি পক্ষ পুরোপুরি সংক্ষুদ্ধ তবেরাষ্ট্রপক্ষ সব আসামির ফাঁসি না হওয়ায় তারা সন্তুষ্ট নন। এজন্য তারা উচ্চআদালতে আপিল করবেন। পাশাপাশি আসামি পক্ষও এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলেজানিয়েছেন।রমনা বটমূলে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখেছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ১০ জন নিহত হন। এঘটনায় করা হত্যা মামলায় আদালত অভিযুক্ত আসামি মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সীওরফে আবুল কালাম ওরফে আবদুল মান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলালউদ্দিন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফেহাফেজ সেলিম হাওলাদার ও মুফতি শফিকুর রহমানকে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০বি ধারায়এবং অভিযুক্ত আসামি মাওলানা তাজউদ্দিন ও আরিফ হাসান সুমনকে একই আইনের৩০২/৩৪ ধারায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। একইসাথে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদেরপ্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হয়। আসামিদের মৃত্যুনা হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশদেয়া হয়।

অন্য আসামি হাফেজ মওলানা আবু তাহের,মওলানা সাব্বির ওরফেআবদুল হান্নান,হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া,মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদএবং মাওলানা আ. রউফকে দণ্ডবিধির ৩২০/১২০বি ধারা এবং শাহাদাত উল্লা ওরফেজুয়েলকে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজারটাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরও ১ বত্সর করে সশ্রম কারাদণ্ডেদণ্ডিত করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে বর্তমান মামলায় হাজতকালীন মেয়াদ বর্ণিতকারাদণ্ডের মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ৫ জন পলাতকরয়েছেন। এরা হলেন, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাইতাজউদ্দিন,জাহাঙ্গীর,আবু বকর,শফিকুর ও আবদুল হাই। মুফতি হান্নানসহ অপরদণ্ডপ্রাপ্তরা কারাগারে আছেন।

আদালতের পর্যবেক্ষণরায়ঘোষণার আগে বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, এ হত্যা মামলা কোনো রাজনৈতিকমামলা নয়। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে বর্ষবরণঅনুষ্ঠানে বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিরাও নিরীহ নাগরিক। এ অনুষ্ঠান কোনোনির্দিষ্ট দল,মত,গোষ্ঠী,বা ধর্মের ছিলো না।বর্ষবরণেরঅনুষ্ঠানে জাতি ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী,নারী-পুরুষ,ছোট-বড় নির্বিশেষ সকলশ্রেণিপেশার হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলো। ঘটনাস্থলে যে দুটি বোমাবিস্ফোরিত হয়েছিলো তা অনেক আগেই ভোর রাতে কৌশলে পুঁতে রাখা হয়েছিলো।বোমা দুটি টাইম ডিভাইস বা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটনো হয়বলে বিশেষজ্ঞ মতামত পাওয়া যায়।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়,বোমাহামলাকারীদের লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি,বস্তু বা গোষ্ঠী ছিলো না।আয়োজক সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সকাল ৮টা ৫ মিনিটেএকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর ১০/১৫ মিনিট পরে আরো একটি বোমাবিস্ফোরণ ঘটানো হয়। প্রথম বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ৭ নিরীহ ব্যক্তি প্রাণহারান এবং ২০/২৫ জন গুরুতর আহত হন। পরে আহতদের মধ্যে আরো ৩ জন চিকিত্সাধীনঅবস্থায় হাসপাতালে মারা যান। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আতঙ্ক সৃষ্টিকরাসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কলুষিত তথা সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করার জন্যইএ বোমা হামলা চালানো হয়। বোমা হামলাকারী ও এর পরিকল্পনাকারীদের এ কাজনিঃসন্দেহে নৃশংস,নির্মম,বর্বর,জঘন্য ও ক্ষমার অযোগ্য। স্বাধীনবাংলাদেশে নৃশংসতম,জঘন্যতম ও বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম এটি।

আসামিদেরস্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি,সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক প্রমাণেরভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আসামিদের প্রতি অনুকম্পা বাসহানুভূতি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।আলোচিত মামলার রায় ঘোষণাউপলক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়। র্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থারসদস্যদের উপস্থিতি ছিলো। রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে আসামিদের কারাগারথেকে আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক রুহুল আমিন পৌনে ১২টায় এজলাশে আসেন।এরপর সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শুরু করেন। ১৫ মিনিটের মধ্যে রায় ঘোষণা করে তিনিএজলাশ ত্যাগ করেন। রায় ঘোষণার সময় আসামিরা স্বাভাবিক ছিলেন।

উল্লেখ্য- ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল। বাংলা ১৪০৮ সালের পহেলা বৈশাখ। রমনার বটমূলে প্রতিবছরের মতো ভোরে শুরু হল ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। কানায় কানায় পূর্ণরমনা বটমূল। সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছিলো বিটিভিতে। সকাল তখন পৌনে ৮টা।হঠাত মঞ্চের সামনে পর পর কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ। মুহূর্তের মধ্যেধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গোটা এলাকা। মানুষের ছিন্ন ভিন্ন দেহ পড়ে থাকেছড়িয়ে ছিটিয়ে। আহতদের আর্তচিত্কারে ভারী হয় ঘটনাস্থল। পণ্ড হয়ে যায় বর্ষবরণঅনুষ্ঠান। ঘটনাস্থলে নিহত হয় ৯ জন। আহত অবস্থায় ২৩জনকে উদ্ধার করে ঢাকামেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির কিছু সময় পরই একজন মারা যায়।