মুজিবনগরের সোনাপুর থেকে ভারতীয় নাগরিকসহ গরু ও মোষ আটক

সকালের ভারতীয় নাগরিক দুপুরে হয়ে গেল বাংলাদেশি

স্টাফ রিপোর্টার: সকালের ভারতীয় নাগরিক দুপুরে হয়ে গেলো বাংলাদেশি। হবেই না বা কেন। স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাসহ বিজিবি ও প্রশাসনের লোকেরা ভারতীয় ও বাংলাদেশী গরুব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা ভোগ করে আসছেন। তাদের ধরাধরি করলে সে সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আটক করা ভারতীয় নাগরিক টাকা আর তদবিরে হয়ে গেলেন বাংলাদেশি। এমনই মন্তব্য করে এ বিষয়ে অসংখ্য অভিযোগ করেছে এলাকার মানুষ।

                মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর সীমান্তে ভারতীয় গরু-মোষসহ বাংলাদেশ সীমানায় অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সিরাজুল ইসলাম (৪০) নামের এক ভারতীয় গরুব্যবসায়ীকে আটকের পর বাংলাদেশি হিসেবে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মুজিবনগর উপজেলা চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযান চালিয়ে ৩৩টি গরু ও ১১টি মোষসহ তাকে আটক করেন। এরপর গরু-মোষগুলো স্থানীয় ইউপি মেম্বার সোহরাব আলীর হেফাজতে রেখে সিরাজুলকে মুজিবনগর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। পুলিশের গাড়িতে সিরাজুলকে আনা হয় মুজিবনগর থানায়। দুপুরে পুলিশ তাকে বাংলাদেশি বলে ছেড়ে দিয়েছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সিরাজুল ইসলাম ভারতের নাকাসিপাড়া থানার পটিয়াডাঙ্গা গ্রামের নিজাম উদ্দীনের ছেলে।

                পুলিশ সুপার মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, মুজিবনগর থানা থেকে আটক ব্যক্তিকে নিজ কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদে সে নিজেকে সোনাপুর গ্রামের আছান আলী বলে পরিচয় দিয়েছেন। অনেকের উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেনের ফুফাতো ভাই। চেয়ারম্যানের মৌখিক এবং স্থানীয় ইউপি সদস্য সোহরাব আলীর লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন জানিয়েছেন, তার এক ফুফাতো ভাইকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। তবে সিরাজুল ইসলাম নামে চেয়ারম্যানের কোনো ফুফাতো ভাই নেই। সিরাজুল নামের কাউকে ধরা বা ছাড়ার ব্যাপারেও তিনি কিছু জানেন না। তাহলে সিরাজুল ইসলাম পুলিশের কাছ থেকে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো? সে প্রশ্লের উত্তর মেলেনি পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে।

                মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি মোকতার হোসেন জানিয়েছেন, আটকের সময় সিরাজুল ইসলাম নিজেকে ভারতীয় বলে জবানবন্দি দিয়েছেন। তার পরিচয় ও ছবিসহ জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানিয়ে তাকে মুজিবনগর থানায় সোপর্দ করা হয়। বাংলাদেশি হিসেবে ছেড়ে দেয়া বিষয়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

                তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি গরুব্যবসায়ীরা ভারতীয় বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হচ্ছে। অথচ ভারতীয় গরুব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অবাধে গরুব্যবসা করছে। তাদের সহযোগিতা করছে সুবিধাভোগীরা। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সমন্বয়সভায় উত্থাপন করা হলেও স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্প তাতে কর্নপাত করছে না। ভারতীয় অনুপ্রবেশের বিষয়টি বিজিবি অস্বীকার করায় অভিযান চালানো হয়। ভারতীয়রা যে বাংলাদেশে আসছে তার প্রমাণ মেলে ভারতীয় নাগরিক সিরাজুলকে গরু-মোষসহ আটকের পর। আটকের পর থেকে বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় সুবিধাভোগীরা তাকে চরম অসহযোগিতা করছে বলেও তিনি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সোনাপুর, বাগোয়ান গ্রামের একাধিকসূত্র জানায়, গরুব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের কিছু নেতা ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আর্থিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। ইউএন’র এ অভিযানে ভারতীয় নাগরিককে আটক করায় সুবিধাভোগী ও বাংলাদেশি গরুব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি আটক গরু-মহিষগুলো স্থানীয় মেম্বার সোহরাব হোসেনের জিম্মায় রেখে সিরাজুলকে মুজিবনগর থানায় সোপর্দ করেন। এরপর শুরু হয় ভারতীয় নাগরিক সিরাজুলকে বাংলাদেশি আর গরুগুলো বৈধ প্রমাণ করতে দেন-দরবার। তারা আরও জানায়, গ্রামে কয়েকজন সিরাজুল থাকলেও তারা কেউই ভারতে বসবাস করেন না। আটকের সময় তারা যে সিরাজুলকে দেখেছিলেন তিনি ভারতীয় নাগরিক। সিরাজুল কোথায় গেলো? এমন প্রশ্নের জবাবে মুজিবনগর থানার ওসি রবিউল হোসেন বলেছেন, আমি কিছুই জানি না। এসপি স্যারের সাথে যোগাযোগ করেন।

ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন জানিয়েছেন, গরু-মোষ আটক করে সোনাপুর গ্রামের দুজনের জিম্মায় দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তিনি এ সময় বলেন, ভ্যাটের কাগজপত্র না এলে ছাড়া হবে না। পরবর্তীতের ভ্যাট পরিশোধ করে গরু ও মোষগুলো মালিকেরা নিয়ে গেছেন। তিনি আছান নামে একজনকে পুলিশ সুপারের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। সিরাজুলের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।

বিজিবির চুয়াডাঙ্গা-৬ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল গাজী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালাতে হলে আইনগতভাবে তাদের অবহিত করতে হয়, যা ইউএনও করেননি। সোনাপুর সীমান্ত থেকে যে গরু-মোষ আটকের কথা শোনা যাচ্ছে তা মুজিবনগর বিওপির সদস্যরা জানেন না। সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সীমান্তবাসীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা দরকার। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা না পেলে শুধু বিজিবির পক্ষে সব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

এদিকে ভারতীয় নাগরিক সিরাজুল থানা থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়ায় শুধু জেলা প্রশাসন নয় এলাকায় বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনা। স্থানীয় কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, সোনাপুর গ্রামসহ আশেপাশেই প্রতিদিনই আসছে ভারতীয় গরু-মোষ। ভারতীয় নাগরিকেরা এগুলো বিক্রি করতে কয়েকদিন ধরে এলাকায় অবস্থান করলেও স্থানীয় বিজিবি সদস্যরা কিছুই বলছেন না। কেননা প্রতিটি গরু ও মোষপ্রতি বিজিবি সদস্যরা অর্থ নিয়ে থাকেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে বিজিবিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশুদৃষ্টি কামনা করেছে এলাকার মানুষ।