ব্যাটের কারিগর কোটচাঁদপুরের প্রসাদ মজুমদার : খরচ বাদে মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা

স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে ১০টি পরিবার

ঝিনাইদহ অফিস: প্রসাদ মজুমদারের বয়স তখন ১৩ কি ১৪ বছর। মাধ্যমিক স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের খেলার মাঠগুলোতে ক্রিকেট খেলা করে বেড়াতেন তিনি। পাকিস্তানি ব্যাট দিয়ে খেলতে গিয়ে প্রায়ই ব্যাট ভেঙে যেতো তার। আবার টাকা জোগাড় করে ব্যাট কিনে তারপর খেলা। যা দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রসাদের জন্য ছিলো খুবই কষ্টকর। ব্যাটের অভাবে তাই মাঝে মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতো তার খেলা।

এদিকে বাবা বৈদ্যনাথ মজুমদার বাড়িতে বসে কাঠ দিয়ে গরুর গাড়ির চাকা তৈরির কাজ করতেন। বাবার এ কাজে সহযোগিতা করতে হতো প্রসাদ মজুমদারের। কাঠের কাজ করতে গিয়ে একদিন তার মাথায় চিন্তা আসে কিছু কাঠ কিনে পিতার কাজের যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যাট বানিয়ে নিতে পারলে বাজার থেকে আর ব্যাট কিনতে হতো না। টাকার অভাবে ব্যাট কিনতে না পেরে খেলাও বন্ধ হতো না। তাই প্রসাদ মজুমদার নিজের লালন-পালন করা একটি মুরগি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে কাঠ কিনে তৈরি করেন ব্যাট। প্রথম দফায় ৮টি ব্যাট তৈরি করেন তিনি। এরপর একটি সময় প্রসাদ মজুমদার ব্যাট তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আজ তার সংসারে বিরাজ করছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ। অথচ এক সময় ছিলো যখন তাদের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো, ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জুটতো না। প্রসাদ মজুমদারের কারখানায় এখন কাজ করছেন ৫/৬ জন শ্রমিক। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের পাড়ার আরো ৮/১০টি পরিবারও এগিয়ে এসেছে এ ব্যাট তৈরির কাজে। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার সালকুপাটি বর্তমানে পরিচিতি পেয়েছে ব্যাটপাড়া হিসেবে।

কে এই প্রসাদ মজুমদার: ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার পাড়াগায়ের একটি গ্রাম সালকুপা। সেই গ্রামের হতদরিদ্র বৈদ্যনাথ মজুমদারের ছেলে প্রসাদ মজুমদার (৩৩)। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়া শেষ করে ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী সাবদালপুর মুনছুর আলী একাডেমীতে। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি তাকে বাবার কাজে সহযোগিতা করতে হতো। যে কারণে ঠিকমতো স্কুল করতে পারতেন না। তাই ঠিকমতো পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও অর্থের অভাবে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি প্রসাদ মজুমদারের। বর্তমানে তিনি ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ করেন। বিয়ে করেছেন কুষ্টিয়া জেলার হালসা গ্রামের জগন্নাথ শর্মার মেয়ে লক্ষ্মী মজুমদারকে। বর্তমানে তার এক ছেলে অনিক মজুমদার (৮) দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।

যেভাবে শুরু ব্যাট তৈরির কাজ: প্রসাদ মজুমদার জানালেন এ অঞ্চলের দোকানগুলো থেকে বেশি দামের ব্যাট কিনতেন তিনি। পাকিস্তানি ব্যাট পাওয়া যেতো সে সময়। কোটচাঁদপুর শহরের সর্কার স্পোর্টস থেকে তারা ব্যাট কিনে খেলা করতেন। বেশি মূল্যের ব্যাট হলেও বেশি দিন ব্যবহার করা যেতো না। একটু জোরে বল লাগলেই ভেঙে যেতো সেই ব্যাট। একদিন সাবদালপুর স্কুলমাঠে খেলা করছিলেন তারা। দু দিন পর রয়েছে কোটচাঁদপুর শহরে একটি ম্যাচ। এমন সময় সাবদালপুর মাঠ থেকে ব্যাট ভেঙে যায়। সে সময় হাতে কোনো পয়সাও নেই, নতুন ব্যাট ক্রয় করবেন। তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন প্রসাদ মজুমদার। কোটচাঁদপুরের ম্যাচে আর অংশ নেয়া হলো না। ব্যাটের অভাবে তিনি অংশ নিতেও পারেননি ওই ম্যাচে। আরেকদিন তাকে একটা ব্যাট কেনার জন্য ঘুরতে হয়েছে বেশ কয়েকজনের কাছে। গ্রামের তখন ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। সেই ম্যাচে অংশ নিতে হবে, কিন্তু ব্যাট ভেঙে পড়ে আছে। অংশগ্রহণের উপায় নেই। তারপর বন্ধুদের কাছ থেকে পয়সা ধার করে ব্যাট কেনেন। এভাবে নানা সময় ব্যাটের জন্য কষ্ট করতে হয়েছে প্রসাদ মজুমদারকে।

প্রসাদ মজুমদার বললেন, ১৯৯৮ সালের গল্প। মাথায় তখন একটা ব্যাটের চিন্তা প্রবলভাবে কাজ করছে। বাবার সাথে গরুর গাড়ির চাকা তৈরির কাজ করছেন। কিন্তু কাজে তার মন ঠিকমতো বসছিলো না। সারাক্ষণ চিন্তা ব্যাট তাকে কিনতেই হবে। এমন সময় মাথায় চিন্তা আসে ব্যাট আর কিনবেন না। নিজেই তৈরি করবেন। কিন্তু কাঠ পাবেন কোথায়। বাবার চাকা তৈরির কাঠ দিয়ে তো ব্যাট হবে না। মনে মনে বুদ্ধি আটলেন প্রসাদ মজুমদার। বাড়িতে একটা মুরগি লালন-পালন করতেন। মা কালিদাসী মজুমদারকে বলে সেই মুরগি বিক্রি করে দেন। সেখান থেকে ১৪০ টাকা পান প্রসাদ। যা দিয়ে ৮ খণ্ড কাঠ ক্রয় করেন। বাড়িতে বসে ওই ৮ খণ্ড কাঠ দিয়ে তৈরি করেন ৮টি ব্যাট। যার একটি দেন পার্শ্ববর্তী রাজাপুর গ্রামের রানা, আরেকটি দেন সাবদালপুর গ্রামের আরিফ হোসেনকে। নিজে দুটি দিয়ে খেলা করতে থাকেন। তার নিজের তৈরি ব্যাট বেশ কিছুদিন ব্যবহার করা যায়। প্রসাদ মজুমদার জানান, ৪টি ব্যাট কাজে লাগানোর পর বাকি ৪টি নিয়ে তিনি যান কোটচাঁদপুর শহরের সেই সকার স্পোর্টসে। দোকানের মালিক গোলাম মোস্তফার সাথে কথা বলে ব্যাট চারটি বিক্রির জন্য রেখে আসেন। এরপর তার ওই চারটি ব্যাট ব্যবহারকারীরা আবারো ওই ব্যাট খুঁজতে আসেন। বিষয়টি দোকানমালিক তাকে জানানোর পর আগ্রহ বেড়ে যায় ব্যাট তৈরির। শুরু হয়ে যায় কাঠ কিনে ব্যাট তৈরি করে বাজারে বিক্রি।

ব্যবসার প্রথম দিক: প্রসাদ মজুমদার জানান, প্রথম দিকে বাবা বৈদ্যনাথ মজুমদারের ব্যবহারের ৱ্যান্দা, হাতুড়ি, সিল, করাত, বিন-বাটাল, বাটাল, মাটামসহ নানা যন্ত্র দিয়ে চলতো তার ব্যাট তৈরির কাজ। প্রতিদিন ৫/৬টি ব্যাট তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। আস্তে আস্তে তার তৈরি করা ব্যাটের চাহিদা বেড়ে যায়। কোটচাঁদপুর শহরের সকার স্পোর্টস ছাড়াও নতুন নতুন ঘর থেকে বায়না আসতে থাকে। কালীগঞ্জে লাবণী স্টোর ছাড়াও যশোর, ঝিনাইদহ, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর অর্ডার আসতে থাকে। তিনি পেশা হিসেবে নিয়ে নেন এই ব্যাট তৈরির কাজ। শুরু হয় গাছ কেনা, ফাঁড়াই করে তা দিয়ে ব্যাট তৈরি। জীবন গাছের কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি করেন প্রসাদ মজুমদার। একটি সময় এসে নিজে সকল যন্ত্রপাতি কেনেন। বাড়িতে করাতকল বসিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ব্যাট তৈরির কারখানা। সাথে স্ট্যাম্পও তৈরি করেন তারা। এভাবে ৪ বছর কাজ করার পর প্রতিবেশীরাও এগিয়ে এসেছেন ব্যাট তৈরির কাজে। প্রসাদ মজুমদার ছাড়াও তাদের পাড়ার কৃষ্ণ মজুমদার, দীপক মজুমদার, পরিমল মজুমদার, পরিতোষ মজুমদার, অশোক মজুমদার, প্রদীপ মজুমদার, শঙ্কর মজুমদারসহ ১০টি পরিবার এ পেশা বেছে নিয়েছেন। যারা প্রতিদিন ৪ থেকে ৫শ ব্যাট তৈরি করছেন।

ব্যবসার খবর : প্রসাদ মজুমদার জানিয়েছেন, প্রথম যখন তিনি ব্যাট তৈরি শুরু করেন তখন তার ব্যাটের চাহিদা থাকলেও বিক্রি করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে তৈরি হওয়া এই ব্যাট যতোই ভালো হোক দোকানদাররা নিতে চাইতো না। যে কারণে অনেক দোকানে রেখে আসতে হতো। বিক্রির পর টাকা দিতেন তারা। এভাবে বাজার দখল করতে হয়েছে তার। এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার ব্যাটের অর্ডার আসে, কিন্তু তারা সরবরাহ করে পারেন না।

তিনি জানান, প্রথমে ব্যাট বিক্রি করে ৫০/৬০ টাকা পিচ দরে বিক্রি করেছেন, বর্তমানে ১৭০/১৮০ টাকায় বিক্রি করেন। সে সময় একটি ব্যাট তৈরি করতে খরচ হতো ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, আর এখন খরচ হয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। এখন তাদের ব্যাট বিক্রিতে দোকানিদের আগ্রহ বেড়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের সব এলাকায় যাচ্ছে তাদের ব্যাট আর স্ট্যাম্প। প্রসাদ মজুমদার জানান, বেশির ভাগ সময় দোকানিরা তাদের কাছে আগাম অর্ডার দেন। সে ক্ষেত্রে তাদের দোকানের মনোগ্রাম দিয়ে ব্যাট তৈরি করতে হয়। যেমন ঢাকার ব্যবসায়ী জেনটেক স্পোর্টসের মালিক যে ব্যাটগুলো তাদের দিয়ে তৈরি করান সেগুলোর নাম থাকে জেনটেক। এছাড়া তারা কিছু নিজস্ব নামে ব্যাট তৈরি করেন। যেমন মারুতী, নাইক, সিএ, এসএস, বিডিএমসহ অন্যান্য। এখন তাদের তৈরি করা ব্যাট নিতে দোকানিরা বাড়িতে চলে আসেন। এখন তিনি ব্যাট বিক্রি করে প্রতিদিন যা আয় করছেন সংসার খরচ মেটানোর পর মাসে ২০ হাজার টাকা জমাতে পারছেন। মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে বর্তমানে তার সংসার স্বচ্ছলভাবে চলছে। আশা করছেন আগামীতে আরো বড় কারখানা গড়ে তোলার।

এ পেশায় অন্যদের কথা: ব্যাট তৈরির সাথে জড়িত অন্যদের মধ্যে আছেন মজুমদারপাড়ার প্রদীপ মজুমদার। তিনি জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষের পেশা কাঠের কাজ। সেই কাঠ দিয়ে ব্যাট তৈরি শুরু করেন প্রসাদ মজুমদার। অল্পদিনে অনেক সাফল্য পেয়েছেন প্রসাদ। তাই দেখে তারাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এখন তাদের পাড়ার অনেকেই এই কাজ করছেন। যারা সকলের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসছে। প্রদীপ মজুমদার আরো জানান, প্রায় ১০ বছর তিনি এই কাজ করছেন। তারা দু ভাই এ ব্যাট তৈরির কাজ করেন। এখন সারাদিন চলে তাদের ব্যাট তৈরির কাজ। চাহিদা অনুযায়ী মাল সরবরাহ করাই কঠিন হয়ে যায় বলে জানান প্রদীপ। বছরের প্রায়ই সব সময় ব্যাট তৈরি ও বিক্রি হয়। তবে ৬ মাস চলে সবচে বেশি কেনা-বেচা।

আরেক কারিগর কিশোর মজুমদার জানান, তাদের গোটা পাড়ায় এখন ব্যাট তৈরী হচ্ছে। গোটা অঞ্চলে তাদের গ্রামটি ব্যাট গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তারপরও পুজির অভাবে আশানুরুপ এবং দোকানীদের চাহিদা মতো ব্যাট তৈরী করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ পেলে তাদের ব্যাবসার আরো প্রসার ঘটাতে পারতেন। পাশাপাশি দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে পৌছে দিতে পারতেন সালকুপার ক্রিকেট ব্যাট।

বড় বড় ব্যবসায়ীদের কথা: ঢাকার গুলিস্থানে রয়েছে জেনটেক স্পোর্টস। প্রতিষ্ঠানটির মালিক রওশন জামিল জানান, অনেক দিন থেকে তার এই ব্যবসা। তিনি দেশের প্রায় সব জেলাতে ক্রিকেট খেলার সামগ্রী সরবরাহ করে থাকেন। রওশন জামিল জানান, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের সালকুপা গ্রামের ব্যাট দেশীয় ব্যাটের মধ্যে সবচে বেশি চাহিদা। এই ব্যাট সারাদেশে খুবই জনপ্রিয়। তিনি বলেন, ব্যাট তৈরির কারিগররা তাদের মাল সাপ্লাই দিয়ে পারেন না। কারণ তাদের কারখানা ছোট। পুঁজির অভাবে তারা কারখানা বড় করতে পারে না। আরেক ব্যবসায়ী কোটচাঁদপুরের সকার স্পোর্টসের মালিক গোলাম মোস্তফা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গিয়েও দেখেছেন সেখানে কোটচাঁদপুরের তৈরি ব্যাট বিক্রি হচ্ছে। এই দেখে তার খুব ভালো লাগে।

প্রশাসনের কথা: এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক কোটচাঁদপুর শাখার ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, অবশ্যই তারা ঋণ পাবেন। এ জাতীয় শিল্প খাতে ঋণ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগের অনুরোধ জানান। কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবপ্রসাদ পাল জানান, পাড়াগায়ের এ ধরনের একটা শিল্প গড়ে ওঠা খুবই ভালো। এই শিল্পটির প্রসারের জন্য সকলের কাজ করা উচিত। তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।