৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক : ঢাকার পথে অভিযাত্রা রোববার

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে থেকে সবাইকে ঢাকায় জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। নির্বাচন প্রতিহত করতে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে সারাদেশ থেকে দলমত, শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সক্ষম নাগরিককে বিজয়ের মাসে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকার পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মিলিত হবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা এলে জনগণ তা মোকাবেলা করবে। পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

টানা অবরোধের পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ঢাকা আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিজয়ের এ মাসে রাজধানীতে বিএনপির কার্যালয়ে সবাই সমবেত হবেন। মা-বোন, ছাত্র-যুবক, কৃষক, আলেমসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ বাসে-লঞ্চে যে যেভাবে পারেন ঢাকা আসবেন। তিনি এ কর্মসূচিকে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ নামে অভিহিত করে বলেন, এ অভিযাত্রা হবে নির্বাচনী প্রহসনকে ‘না’ বলতে এবং গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলতে। এ অভিযাত্রা হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অর্থবহ নির্বাচনের দাবিতে। এ অভিযাত্রা হবে শান্তি, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের পক্ষে। এ অভিযাত্রা হবে ঐতিহাসিক। সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ওই কর্মসূচিতে বাধা দেবেন না। তাহলে আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে একটি প্রহসন উল্লেখ করে তা ঘৃণাভরে বর্জনের জন্য বাংলাদেশের নাগরিক ও ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যে প্রহসনকে সারা দুনিয়ার কেউ বৈধতা দিতে রাজি নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাতে শামিল হচ্ছে না, সেই প্রক্রিয়ায় জড়িত না হওয়ার জন্যও আমি জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করছি।

সরকারকে আবারও সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তিন দফা আলোচনার পরও সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কেবল লোক দেখানোর জন্য তারা আলোচনায় এসেছিলেন। এটা ছিলো সময়ক্ষেপণে তাদের এক প্রতারণাপূর্ণ কৌশল। এর আড়ালে তারা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথেই এগিয়ে গেছে। সরকারকে বলবো, নিজেরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। এখন বাংলাদেশকে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিপদে ফেলবেন না। এ দেশ, এ দেশের মানুষ আপনাদের অনেক দিয়েছে। তাদের প্রতি প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলবেন না। অনমনীয়তা ও হঠকারিতা পরিহার করে বাস্তবের দিকে ফিরে তাকান।

তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারি সেটা ইলেকশন নয়, সিলেকশন হচ্ছে। সেখানে জনগণ ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ নির্বাচন ও এর মাধ্যমে গঠিত সরকার ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল’ হবে না। এটা হবে- ‘বাই দ্য ইলেকশন কমিশন, ফর দ্য আওয়ামী লীগ, অফ দ্য আওয়ামী লীগ’। এ গণবিরোধী প্রক্রিয়া বন্ধ করার সাধ্য না থাকলে ইলেকশন কমিশনের অন্তত পদত্যাগ করা উচিত।

দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলের অবস্থান তুলে ধরতে গুলশানের নিজ কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় তিনি সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করেন। এর আগেই সেখানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত হন। জনাকীর্ণ সাংবাদিকদের সামনে ৫টা ৫০ মিনিটে খালেদা জিয়া তার লিখিত বক্তব্য শুরু করেন। প্রায় এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে তিনি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘সিলেকশন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে ভোটকেন্দি ক সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় সবাইকে নিয়ে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের আহ্বান জানান তিনি। ভোটারবিহীন ওই নির্বাচনে গঠিত সরকার হবে অবৈধ। সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তান সংসদে নেয়া নিন্দা প্রস্তাবের সমালোচনা করেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে পরিচালিত যৌথবাহিনী দিয়ে নেতাকর্মীদের হত্যা ও গুম করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

চলমান আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত, ব্যাপক ও পরবর্তী ধাপে উন্নীত করার লক্ষ্যে এ ঢাকা অভিযাত্রা কর্মসূচি দেয়া হয়েছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি যারা রাজধানীতে আছেন, তাদের প্রতিও আমার আহ্বান, আপনারাও সেদিন পথে নামুন। যারা গণতন্ত্র চান, ভোটাধিকার রক্ষা করতে চান, যারা শান্তি চান, যারা গত পাঁচ বছরে নানাভাবে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, শেয়ারবাজারে ফতুর হয়েছেন সবাই পথে নামুন। জনতার এ অভিযাত্রায় কোনো বাধা না দেয়ার জন্য আমি সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি। যানবাহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ করবেন না। নির্যাতন, গ্রেফতার, হয়রানির অপচেষ্টা করবেন না। প্রজাতন্ত্রের সংবিধান নাগরিকদের শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার দিয়েছে। সেই সংবিধান রক্ষার শপথ আপনারা নিয়েছেন। কাজেই সংবিধান ও শপথ লংঘন করবেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলছি, দেশবাসীর এ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি সফল করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা আপনারা দেবেন।

প্রধানমন্ত্রী এখনও প্রহসনের নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় মন্তব্য করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন- তিনি বলেছেন, দশম সংসদ নিয়ে কোনো আলোচনা নয়। পরে একাদশ সংসদ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এটা যুক্তির নয়, জেদের কথা। এটা বাস্তবসম্মত নয় বরং অপকৌশলের কথা। আমি তাকে অনুরোধ করি, একগুঁয়েমি পরিহার করুন। গণতান্ত্রিক রাজনীতি হচ্ছে ‘আর্ট অব কমপ্রোমাইজ’। সমঝোতা স্থাপন করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। ১৯৯৬ সালে আমরা আপনাদের দাবি মেনে নিয়ে সমঝোতা স্থাপন করেছিলাম। এখন আপনারা ক্ষমতায় আছেন। জনগণের দাবি মেনে নিয়ে সমঝোতায় আসুন। এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। প্রহসনের নির্বাচনের তফশিল বাতিল করুন। আলোচনা শুরু করুন। আমরাও আলোচনায় বসতে রাজি আছি। জনগণের অর্থের অপচয় করে ভোটবিহীন, প্রার্থীবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একটা অর্থহীন প্রহসনের নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই। এতে শুধু আপনারাই কলঙ্কিত হবেন না, গণতন্ত্রও ধ্বংস হবে। আওয়ামী লীগের ভেতরে বিবেকবান, গণতন্ত্রমনা ও দেশপ্রেমিক মানুষ যারা আছেন তাদের প্রতিও আমার আহ্বান, এ দেশ এবং দেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, জনগণের প্রত্যাশা ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে আপনারাও অবস্থান নিন। স্বৈরশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। জনগণের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করুন।

খালেদা জিয়া বলেন, আমরা একটা সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকেও অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তার পক্ষে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে দেশবাসী এর মাধ্যমে সমঝোতার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রমাণ পেয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এসে সরকারের সাথে বিরোধী দলের বৈঠকের উদ্যোগ নেন। আমরা তাতেও সাড়া দিয়েছি। যদিও মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটক আমাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়নি। বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। এমনকি একতরফা নির্বাচনের ঘোষিত তফশিল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়নি। অর্থাৎ, আলোচনার একট সুষ্ঠু পরিবেশ সরকারের তরফ থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। তা সত্ত্বেও আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট সুরাহা করার ব্যাপারে আন্তরিকতার সর্বোচ্চ প্রমাণ আমরা দিয়েছি। দুঃখের বিষয়, তিন দফা আলোচনা সত্ত্বেও সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে কোনো সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তারা সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়নি।