২৯ শিক্ষা কর্মকর্তা বদলি : যোগদানে টালবাহানা

প্রশ্ন ফাঁস বই কেলেঙ্কারি ঘুষ গ্রহণসহ নানা অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার: প্রশ্ন ফাঁস, দুর্নীতি-অনিয়ম, বিপুল অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ, বই কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা প্রশাসনের ২৯ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এই আদেশে এমন কিছু পদে বদলি করা হয়েছে যেখানে কোনো পদ শূন্য নেই। তাই গোঁজামিলের এ বদলি আদেশের ২৪ দিন পরও কয়েকজন কর্মকর্তা উল্লেখিত সেই পদে যোগদান করতে পারেননি। কারও কারও নতুন পদ শূন্য থাকলেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তারা বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগ দেননি। ফলে দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধের উদ্দেশ্যে শিক্ষাপ্রশাসনের আলোচিত বদলি কার্যক্রম শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।

বাংলাদেশ সার্ভিস রুলের ৮১ ধারায় বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় বা বিভাগের বদলি আদেশের পর নতুন কর্মস্থলে যোগদানের প্রস্তুতির জন্য একজন কর্মকর্তা সর্বোচ্চ ৬ দিন সময় পাবেন। তবে একই শহরে বদলির আদেশ হলে প্রস্তুতির কোনো সময় পাবেন না। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই বদলির আদেশ জারি করার প্রায় এক মাস হয়ে গেলেও কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো বর্তমান কর্মস্থল ত্যাগ করেননি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করতে বলা হয়েছে। তাই কয়েকজন কর্মকর্তা কৌশলে এর ভুল ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। আর এই ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ পেয়েছেন তাদের বর্তমান কর্মস্থলে কোনো কর্মকর্তাকে পদায়ন না করায়। অথচ সম্প্রতি ২২ জেলা প্রশাসকের নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রেও বলা ছিলো এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। তারা প্রত্যেকে এই আদেশের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পূর্বের কর্মস্থল ত্যাগ ও নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন।

জানা যায়, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়ে পদায়নের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে একধরনের স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্য চলে আসছে। এ কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর ও সংস্থায় পদায়নের জন্য নীতিমালা জারি করে। কিন্তু সেই নীতিমালা এখনও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলছে। সর্বশেষ এই বদলি আদেশ নিয়েও শুরু হয়েছে নানা ধরনের টালবাহানা।

জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারির বদলি আদেশ তালিকার একনম্বরে ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম। তাকে বদলি করা হয় মাদারীপুরের বরহামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে। কিন্তু সেই কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে একজন কর্মরত রয়েছেন। একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং-এর উপ-পরিচালক (সহযোগী অধ্যাপক) এসএম কামাল উদ্দিন হায়দারকে বদলি করা হয় মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে। সেখানেও কোনো পদ শূন্য নেই। ফলে এই দুই কর্মকর্তা বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করতে পারেননি। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বদলি আদেশের ২৪ দিন পরও নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি। তিনি প্রায় ৬ বছর ধরে এই পদে কর্মরত রয়েছেন। এবার তাকে ভোলা সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রশাসনে নানা অনিয়মের দায়ে আলোচিত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলির পরও নির্দিষ্ট সময়ে বর্তমান কর্মস্থল ছাড়েননি। বদলি আদেশের ২০ দিন পরও কর্মস্থল না ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকি বলেন, এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলা হয়নি। এ ছাড়া তার পদে এখনও নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তাই যতদিন তার চেয়ারে কেউ না আসেন ততদিন হয়তো থাকবেন। কারণ কেউ আসলে তাকে তো কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম বলেন, তাকে যেখানে বদলি করা হয়েছে সেখানে কোনো পদ খালি নেই। ফলে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না। এ বিষয়ে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং মূলত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের কাজ করত। এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩০ ডিসেম্বর। এরপর এই প্রকল্পকে রাজস্বখাতে নেয়ার কার্যক্রম চলছে। তবে বিশ্বব্যাংকের এই প্রকল্পের স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা তিনি। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে এর যাবতীয় কার্যক্রম তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন নতুন কোনো কর্মকর্তা এর স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তাও হতে পারবেন না। ফলে দুই দিকেই জটিলতা রয়েছে। তবে সরকার তাকে যেখানে বদলি করবে তিনি সেখানেই কাজ করবেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং-এর উপ-পরিচালক (সহযোগী অধ্যাপক) এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, তাকে যেখানে বদলি করা হয়েছে, সেখানে কোনো শূন্য পদ নেই। ফলে তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে পারছেন না এবং বর্তমান কর্মস্থলে থাকার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি তিনি সচিব বরাবর লিখিতভাবে জানিয়েছেন।

তবে বদলিকৃত ২৯ কর্মকর্তার মধ্যে কয়জন নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন সে তথ্যও রাখেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ বাংলাদেশ সার্ভিস রুলে কোনো কর্মকর্তা নতুন কর্মস্থলে যোগদানের পূর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে জানানোর কথা বলা হয়েছে। যদি কোনো কর্মকর্তা জরুরি কোনো সমস্যার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে নতুন কর্মস্থলে যেতে না পারেন সেজন্য অনুমতি নিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব এজেডএম নূরুল হক বলেন, বদলিকৃত কর্মকর্তারা কতজন তাদের নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছেন সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আর যেসব কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে তাদের কর্মস্থলে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের কাজ নানা জটিলতার কারণে একটু দেরি হচ্ছে। যারা পদশূন্যতার কারণে জটিলতায় ভুগছেন, তাদের ওই পদ দ্রুত শূন্য করা হবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, যাদের বদলি করা হয়েছে তারা কেউ আগের কর্মস্থলে থাকতে পারবেন না। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের পদায়নের জন্য যে নীতিমালা জারি করা হয়েছে সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর ও সংস্থার উইংগুলোতে যারা সবচেয়ে বেশি সময় রয়েছেন, তাদের আগে বদলি করা হবে। এর সাথে দীর্ঘসময় ধরে যারা বিভিন্ন পদ ধরে রেখেছেন তাদের সবাইকে বদলি করা হবে। তিনি আরও বলেন, বদলি কার্যক্রম একটি কঠিন প্রক্রিয়া।

বিভিন্ন জটিলতার কারণে শিক্ষা ক্যাডারদের এই জটিলতা নিরসন করা যাচ্ছে না। তবে পদায়ন নীতিমালা পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য কঠিন পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা প্রশাসনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। ফলে ২৯ কর্মকর্তাকে বদলি করা হলেও এই সিন্ডিকেটে আরও তিন শতাধিক কর্মকর্তা বহাল আছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের লোভনীয় পদে। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের শিক্ষা বোর্ড এবং প্রকল্প অফিসে অনেকে ২০ বছরের অধিক সময় ধরে কর্মরত রয়েছেন। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নানা অনিয়মের প্রতিবেদন দেয়ার পরও তাদের নতুন কোনো কর্মস্থলে পদায়ন করা যাচ্ছে না। কয়েকজনকে পাঠানো হলেও তারা আবার আগের কর্মস্থলে ফিরে এসেছেন। তবে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো শিক্ষা ক্যাডারকে প্রশাসন ও শিক্ষকতা-এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা। যারা শুরু থেকে প্রশাসন বেছে নেবেন, তারা সেখানে থাকবেন। আর যারা শিক্ষকতা পছন্দ করেন, তারা শিক্ষকই হবেন।