১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় : দালালের খপ্পরে পড়ে দুটি পরিবার আজ নিঃস্ব

 

মনজুর আলম: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মাহামায়া গ্রামের তুহিন রেজাকে মালয়েশিয়ায় আটকে রেখে দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায়ের পর এবার পার্শ্ববর্তী চান্দুয়ালি গ্রামের রাশিদুল ইসলাম এবং রানা আহমেদ নামের দু যুবককে লিবিয়ায় আটকে রেখে মুক্তিপণ বাবদ ১৭ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস দালালদের ডেরায় বন্দি রেখে কৌশলে দফায় দফায় দু যুবককের পরিবারের নিকট থেকে এ বিপুল পরিমাণে টাকা আদায় করা হয়েছে। দু যুবকের পরিবারের নিকটজনেরা জানান, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য কৌশলে দফায় দফায় পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। পরিবারের নিকটজনদের কাছে গ্রামের কয়েকজনের মাধ্যমে টাকা দাবি করা হয়েছে। রাতে দিনে এক মুঠো ভাত আর একটি কাঁচা মরিচ দেয়া হতো। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে ছেলেকে মুক্তি করতে দালালদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণের টাকা দিতে হয়েছে। গত সোমবার রাতে দুই যুবককে লিবিয়ায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। ছেলেকে মুক্ত করতে ধার-দেনা ও জায়গা জমি বিক্রি করে পরিবার দুটি নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। দীর্ঘসময় দালালদের লাগাতার হুমকিতে ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় পেতে ঘটনা প্রশাসনকে জানানো তো দূরের কথা সামান্য টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি অভিভাবকরা। এদিকে দুই যুবককে লিবিয়ায় আটক রেখে দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায়ের মূলহোতা সাগর আহমেদ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। সাগর আহমেদ চুয়াডাঙ্গার শিশিরদাঁইড় গ্রামের উসমান আলীর ছেলে এবং চান্দুয়ালি গ্রামের লিখনের শ্যালক। এ মর্মে অভিযোগ করা হয়েছে।

অভিযোগে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুহাটি ইউনিয়নের চান্দুয়ালি গ্রামের বাজারপাড়ার সদর উদ্দিনের ছেলে রাশিদুল ইসলাম এবং একই গ্রামের খালপাড়ার রিয়াজুল ইসলামের ছেলে রানা আহমেদ নামের দুই যুবক বিদেশে ভালো চাকরির বেশি বেতনে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। সে সময় গ্রামের মঙ্গল মণ্ডল এবং চুয়াডাঙ্গার শিশিরদাঁইড় গ্রামের সাগরের খপ্পড়ে পড়ে। লিবিয়ায় ভালো চাকরি ও বেতন পেতে প্রত্যেকে তিন লাখ টাকা মৌখিকভাবে চুক্তি করা হয়। চুক্তিকৃত টাকা পরিশোধ করার পর বিদেশ পাঠানোর নামে চলতে থাকে নানা টালবাহানা। এরই মধ্যে মঙ্গল মণ্ডল মারা যান। ওই সময় সাগরের ভগ্নিপতি লিখনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। সে সময় ফ্লাইটের নামের কয়েক দফা ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। অবশেষে দুইজনকে জানানো হয় আরো ১ লাখ করে মোট চার লাখ টাকা না দিলে ভালো কাজ এবং বেশি বেতনের চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। আবার টাকা ফেরত পেতে হলে সময় লাগবে। এ সব কথা শুনে আরো ১ লাখ টাকা করে দালালদের নিকট দেয়া হয়। দুইজনকে ২০ জুন লিবিয়ায় পাঠানোর জন্য আবারও ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্লাইটে গত ৪ জুলাই দুইজন লিবিয়ায় পৌঁছে। পৌঁছানোর পর দুইজনকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। আর পরিবারের লোকজনদের জানানো হয়, রাশিদুল এবং রানাকে বিদেশ পাঠানোর জন্য কোনো টাকা অফিসে জমা দেয়া হয়নি। দুজনার জন্য দ্রুত ৬ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য তাগাদা দেয়া হয়। মাসখানেক লিবিয়ায় আটকে থাকার পর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে দালালদের কথামতো দু পরিবার ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করে। তাদের মুক্তি দেয়ার নামে চলতে থাকে টালবাহানা পরে আরো ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। আর এই টাকা আদায়ের জন্য দুইজনকে দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়। গ্রামের কয়েকজন দালালের মাধ্যমে চলতে থাকে মুক্তিপণের জন্য দরকষাকষি। অবশেষে কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে ১ সেপ্টেম্বর দু পরিবারের লোকজন দালালদের দেয়া ঠিকানায় ঢাকায় কথিত এজেন্সি অফিসে যাই। সেখানেই ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হলে সোমবার রাতে দুইজনকে লিবিয়ায় বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে পরিবারের লোকজন জানান। এই ঘটনায় গ্রামের পরিবার দুটি জায়গা জমি বিক্রি, ধারদেনা করে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আবার দুই যুবক লিবিয়াতে কাজ না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এ বিষয়ে রাশিদুল ইসলাম ও রানা আহমদের পিতা-মাতার নিকট জানতে চাইলে তারা অভিন্ন ভাষায় জানান, দালালদের সাথে চুক্তির টাকা আমরা বিদেশ যাওয়ার আগেই পরিশোধ করে দিই। কিন্তু ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠানোর পর সেখানে একটি ঘরে আটকে রাখে। কোনো রকম বাঁচিয়ে রাখার মতো রাতে দিনে এক মুঠো ভাত আর একটি কাঁচা মরিচ খেতে দিতো। তাদের নিকট থেকে মুক্তির জন্য দফায় দফায় টাকা আদায় করা হয়। এক পর্যায়ে গ্রামের কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে ঢাকায় গিয়ে তাদের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করার পর ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছে। এখানে তাদের ১৭ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। দালালের খপ্পড়ে পড়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেছি। আবার ছেলেও সেখানে কাজ না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত দালাল সাগর আহমদের সাথে একাধিকবার যোগযোগের পরও পাওয়া যায়নি, তার মোবাইলফোনটিও বন্ধ রয়েছে। তবে চান্দুয়ালি গ্রামের কার মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দালালদের নিকট দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার তদন্ত কর্মকর্তা হরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, এই ঘটনায় কেউ এখনো থানায় অভিযোগ করেননি। তবে অভিযোগ পেলে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুহাটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে বিদেশ পাঠানোর নামে দালালচক্র গড়ে উঠেছে। তারা গ্রামের সহজ সরল মানুষের নিকট চটকাদারি কথা বলে বিদেশে ভালো চাকরি আর বেশি টাকা বেতনের চাকরির প্রলোভন কৌশলে মানবপাচার করছে। যেকোনো ভাবেই বিদেশ পাঠানোর পর বন্দি করে রেখে পরিবারের নিকট মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার বা দেরি হলে বন্দিদের ওপরে পাশবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। দিনদিন মানবপাচারকারী চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এখনই মানবপাচার রোধে গ্রামবাসীকে সচেতন করতে না পারলে মারাত্মক আকার ধারণ করবে। দালালদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হবে শ শ পরিবার। সৃষ্টি হবে সামাজিক বিরোধ আর নিরীহ জনগণের বসবাসের স্বাভাবিক পরিবেশ অনুপযোগী হয়ে পড়বে।