সৌদি থেকে ফিরে পাল্টে যান জঙ্গি দম্পতি তানভীর-ফাতেমা

স্টাফ রিপোর্টার: একটি বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চ পদের কর্মকর্তা ছিলেন তানভীর কাদেরী আর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে কাজ করছিলেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়- এই দম্পতি কীভাবে জঙ্গিবাদে জড়ালেন তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো দুই বছর আগে সৌদি আরব থেকে ফিরে তাদের বদলে যাওয়ার তথ্য। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার আজিমপুরের একটি বাসায় পুলিশের অভিযানের সময় নিহত হন তানভীর। ওই বাসা থেকে আহত অবস্থায় যে তিন নারীকে আট করা হয়েছিলো তাদের একজন ফাতেমা। তাদের যমজ দুই ছেলে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা বলছেন, গত মাসের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জে পুলিশি অভিযানে ‘নব্য জেএমবি’র নেতা তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর জঙ্গি দলটির সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছিলেন তানভীর। ‘আব্দুল করিম’ ও ‘শমসেদ’ নামে সংগঠনে পরিচিত ছিলেন তিনি। করিম নাম ব্যবহার করেই তিনি বসুন্ধরা আবাসিকে গুলশান হামলাকারীদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন।  গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাটিকামারি গ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৪ সালে হজ করতে সপরিবারে সৌদি আরবে যান তানভীর। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তানভীরের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রতা ধরা পড়ে আত্মীয়দের চোখে। ফাতেমাও তখন থেকেই হিজাব পরা শুরু করেন।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম শুক্রবার বলেন, আহত তিন নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আজিমপুরের বাসায় কারা কারা আসতো তা জানার চেষ্টা করছি। কিছু দিন আগে ওই বাসা ভাড়া নেয় জানিয়ে তারা বলেছে, যারা আসতো তারা তানভীরের সাথে দেখা করতে আসতো। কী নিয়ে তাদের আলোচনা হতো তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে তানভীর ও ফাতেমার জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানা ছিলো না বলে দাবি করেছেন পরিবারের সদস্যরা।

বাটিকামারি গ্রামের এসএম বাতেন কাদেরীর ছেলে তানভীর গাইবান্ধা সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি এবং তার দুই বছর পর গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দুটি বেসরকারি কোম্পানি ঘুরে সর্বশেষ ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখায় উচ্চ পদে যোগ দিয়েছিলেন তানভীর। হজ থেকে ফিরে ২০১৪ সালে ছেড়ে দেন সেই চাকরি। এরপর ‘আল সাকিনা হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ নামে একটি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ফাতেমার সাথে তানভীরের সংসার জীবন প্রায় দেড় দশকের। ২০০১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল তাওয়াতের মেয়ে ফাতেমার সাথে বিয়ে হয় তার। ফাতেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এ চাকরি করতেন। তিনিও জঙ্গিবাদী তৎপরতায় জড়িত বলে পুলিশের ধারণা। আজিমপুরের বাসায় অভিযানে গেলে ফাতেমাসহ তিন নারী মরিচের গুঁড়া ও ছোরা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় বলে সেদিন জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বাংলাদেশে ধর্ম চর্চা নিয়ে ছাত্রজীবন থেকেই তানভীরের মধ্যে ‘অসন্তোষ’ ছিলো বলে তার এক সময়ের সহপাঠী মাহমুদুর রশিদ রাসেল জানান। তিনি বলেন, বন্ধুদের সাথে আলোচনা হলে তানভীর বলত- ‘এদেশে সঠিকভাবে ধর্ম মানা হয় না’। তানভীর কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত না থাকলেও এক সময় ছাত্র শিবিরের সমর্থক ছিলেন বলে তার আরেক সহপাঠী জানান। তানভীরের পূর্ব পুরুষ ছিলেন পাকিস্তানের বাসিন্দা। তার দাদা প্রয়াত আব্দুল ওয়াহেদ গত শতকের প্রথম দিকে পেশোয়ার থেকে তাবলীগ করতে এসে গাইবান্ধার ফুলছড়িতে বিয়ে করে বসতি গাড়েন। পরে তানভীরের বাবা বাতেন কাদেরী গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের পশ্চিম বাটিকামারি গ্রামে বাড়ি করেন বলে স্বজনরা জানান।

গাইবান্ধা সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান জানান, গত সোমবার তারা বাতেন, তার বড় মেয়ে তানজিলা বুলবুল ও ভগ্নিপতি জিয়া ইসলামকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ছেলের লাশ গ্রহণ করবেন না বলে সেদিন পুলিশকে বললেও পরে মত পাল্টেছেন বাতেন কাদেরী। শুক্রবার তিনি বলেন, পরিবারের কেউ লাশ নিতে রাজি না। তবে বাবা হিসেবে ছেলের লাশ দাফন করা আমার কর্তব্য। তাই ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী ছেলের লাশ দাফন করতে চাই। কোথায় দাফন করবো, সেটা লাশ পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেবো। বাতেন কাদেরী বাংলাদেশ টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বিভাগে চাকরি করতেন। এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে তিনি দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। এখন জর্দার ব্যবসা করেন।