সিভিল সার্জনের নির্দেশও মানছেন না কেউ কেউ

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর হয়নি : জরুরি বৈঠক

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর হচ্ছে না। বৈঠক করে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া সত্ত্বে তা কেউই আমলে নিচ্ছেন না। এ যেন রামরাজত্ব। সদর হাসপাতালের আরো কয়েকটি বিভাগের দুর্নীতির সন্ধান মিলেছে। সেসব ভয়ঙ্কর দুর্নীতির খবর ফাঁস হওয়া দরকার বলে খোদ হাসপাতালেরই কেউ কেউ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

গত মঙ্গলবার দৈনিক মাথাভাঙ্গায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জনবল সঙ্কটসহ অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন নিয়ে হাসপাতালপাড়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বুধবার সকাল ৯টায় সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম জরুরি বৈঠক ডাকেন। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের রুমে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয় চিকিৎসক, নার্সসহ কর্মচারীদের। কিন্তু গতকালও একই দৃশ্য চোখে পড়ে। অধিকাংশ চিকিৎসকই তোয়াক্কা করেননি সিভিল সার্জনের নির্দেশ। সিভিল সার্জন স্বাস্থ্যসেবায় আন্তরিক হলেও দুর্নীতি পরায়ণ কতিপয় চিকিৎসক ও কর্মচারীদের জন্য আন্তরিকতা বাস্তবে রূপ লাভ করছে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী অনেকেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে রোগী দেখার কথা থাকলেও বেলা ১টার পর কোনো চিকিৎকই থাকছেন না। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ দেয়ার পরও গতকাল একই দশা দেখা গেছে। তবে ১০৮ নম্বর কক্ষের চিকিৎসক হারুন অর রশীদ পলাশ ও ১২৭ নম্বর কক্ষের ডা. নুর উদ্দিন রুমিকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের অন্য রকম দুর্নীতির খবর বেরিয়ে এসেছে। অভিযোগকারীরা জানান, এ বিভাগের টাকা আদায়ের রশিদে চলে শুভঙ্করের ফাঁকি। রশিদের প্রথমাংশে যা লেখা হয়, তার সাথে মুড়ি অংশের কোনো মিল থাকে না। তাছাড়া টাকা নেয়া হলেও অনেককেই রশিদ দেয়া হয় না। ফলে অধিকাংশ টাকাই পকেটস্থ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন।

অভিযোগকারীরা জানান, হাসপাতালের ১১০ নম্বর কক্ষে দেয়া হয় জলাতঙ্ক রোগের ইনজেকশন। এখানে বিনামূল্যে রাবিপুলি ভ্যাকসিন দেয়ার কথা থাকলেও রোগীদের অভিযোগ বাইরে থেকে কিনিয়ে আনানো হয়। তা থেকে টাকার বিনিময়ে কাউকে কাউকে দেয়া হয়।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের প্যাথোলজি বিভাগে চলে এলাহী কারবার। সরকার এখানে প্রতি বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত লাখ লাখ টাকার রি-এজেন্ট দিলেও তা হওয়া হয়ে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা অহরহ হলেও কাগজে-কলমে দেখানো হয় সামান্য।

সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রচুর ওষুধ সরবরাহ করছে হাসপাতালে। সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন করা হলেও কোনো রোগীকেই বাইরে থেকে ওষুধ কেনার প্রয়োজন পড়ে না বলে মন্তব্য করেছেন চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন সচেতন ব্যক্তি। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছে না। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারেও রয়েছে নানা অনিয়ম। প্রায়ই দেখা যায়, রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর পর দামি দামি ওষুধের একটি ফর্দ ধরিয়ে দেয়া হয়। রোগীর লোকজন তড়িতড়ি করে নিয়ে আসে। কিন্তু তারা জানে না এই ওষুধ সত্যিই কি তার রোগীর শরীরে ঢুকেছে? এখানে কিছু কিছু আইটেম রোগীর জন্য ১টা লাগলেও দুটো লিখে দেয়া হয়। বাড়তিগুলো কোথায় যায়? এ প্রশ্ন সাধারণ রোগীদের।

জরুরি বিভাগে সব সময় দেখা যায় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড়। কেউ কেউ চিকিৎসকের ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেন তার কোম্পানির ওষুধ লেখা হচ্ছে কি-না। প্রায় প্রতিদিনই রিপ্রেজেনটেটিভদের দখল থাকে সদর হাসপাতাল। কোনো চিকিৎসকের সাথে রাউন্ডে যান তারা। ফলে রোগীর লোকজন বেকায়দায় পড়েন। তারা গোলকধাঁধাঁয় পড়েন কোন ব্যক্তি ডাক্তার, আর কে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। তাদের দাপটে চিকিৎসকগণের ইচ্ছা থাকলেও ব্যবস্থাপত্রে সঠিক ওষুধটি লিখতে পারেন না।

অন্যদিকে রোগীদের খাবারের বেহাল অবস্থা সেভাবেই আছে। গতকালও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের পাঙাস মাছ দেয়া হয়েছে। লেজ-মাথা দেয়ার বারণ থাকলেও তা দেয়া হয়। একজনের ভাত তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, সকালের নাস্তা দেয়া হয় ওয়ার্ডে রাউন্ডের পর। সে সময় যেসব রোগীর ছুটি হয়ে যায়, তাদেরকে নাস্তা দেয়া হয় না। এ ছাড়া যেসব রোগী নতুন ভর্তি হয়, তাদেরও প্রথমদিন খাবার দেয়া হয় না। এভাবে দেখা যায় ১০০ জন খাবার পাওয়ার কথা থাকলেও প্রতিদিন গড়ে ২০ জন রোগী প্রতিদিন ছুটি করে চলে যায়। ২০০ গ্রাম চালের ভাত ও দেড়শ গ্রাম ওজনের মাছ একেক রোগী পাওয়ার কথা থাকলেও তা দেন না রাধুনি সুফিয়া খাতুন। খাসি ও দেশি মুরগির মাংস দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় না বললেই চলে। দেয়া হয় পোল্ট্রি মুরগির মাংস। যা অনেক রোগীই খায় না।

বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সিভিল সার্জন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে চুয়াডাঙ্গার সাধারণ মানুষের দাবি। এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, বুধবার সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে বলেছি। দুপুরে দামুড়হুদায় ছিলাম। শুনেছি অনেকেই আমার নির্দেশ আমলে নেননি। বৃহস্পতিবার (আজ) আবার বৈঠক করবো। এরপর কেউ দায়িত্বে অবহেলা বা দুর্নীতি-অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।