সিনিয়র কর্মকর্তার নির্দেশে হত্যায় অংশ নিই

 স্টাফ রিপোর্টার; সিনিয়রঅফিসারদের নির্দেশে বাধ্য হয়ে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছেন বলে আদালতকেজানিয়েছেন র‌্যাবের তিন সদস্য। শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়ালম্যাজিস্ট্রেটের তিন আদালতে পৃথকভাবে তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এসময় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনাও দিয়েছেন তারা।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিদেয়া তিন র‌্যাব সদস্য হলেন- হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক হিরামিয়া ও সিপাহী তৈয়ব আলী। জবানবন্দি প্রদানকালে বেশ কান্নাকাটি করেন তারা।আদালতকে জানান, চাকরি এবং জীবন রক্ষার স্বার্থেই ওই হত্যাকাণ্ডে জড়ান তারা।নারায়ণগঞ্জেসাত খুনের ঘটনায় ২৬ আগস্ট গ্রেফতার হওয়া র‌্যাবের ৫ সদস্যের মধ্যে তিনজনশনিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। বাকি দুজনকে ৮ দিনেররিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এদিকে সাত খুনের ঘটনায় শনিবার নতুন করে এক র‌্যাবসদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার নাম শিহাব উদ্দিন। তাকেও ৮ দিনেররিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কেএম ফজলুর রহমান জানান, র‌্যাবের তিন সদস্য হত্যাকাণ্ডের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার এবং ঘটনার বর্ণনাদিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিতে তারাজানিয়েছেন, সিনিয়র অফিসারদের (র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এসএম রানা) নির্দেশে তারা বাধ্য হয়ে এ হত্যাকাণ্ডেজড়িয়েছেন।ফজলুর রহমান আরও বলেন, আমরা আশা করছি, এ মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকেবন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় অচিরেই দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করাসম্ভব হবে।

নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনী রূপমেরআদালতে জবানবন্দি দেন হাবিলদার এমদাদুল হক। কেএম মহিউদ্দিনের আদালতেল্যান্সনায়েক হিরা মিয়া এবং মনোয়ারা বেগমের আদালতে র‌্যাবের সিপাহী আবুতৈয়বের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

আরও এক র‌্যাব সদস্য গ্রেফতার: ৭খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১ কনস্টেবল শিহাবউদ্দিনকে শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকেআদালতে হাজির করেন হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশেরওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল। তিনি ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালতশুনানি শেষে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকারমহিদ উদ্দিন জানান, মামলার তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যেআদালতে ১৬৪ ধারায় ১৭ জন জবানবন্দি দিয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন স্বীকারোক্তিমূলকএবং ১২ জন সাক্ষী হিসেবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। এটিএকটি বড় মামলা, একটি সুন্দর তদন্তের জন্য আরও সময় প্রয়োজন। আমরা খুব দ্রুততদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করব।২৭ আগস্ট পৃথক দুটি হত্যা মামলায়র‌্যাবের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তাদের কাউন্সিলরনজরুলসহ ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির দায়ের করামামলায় ৮ দিনের রিমান্ডে নেন ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল। রিমান্ডের দ্বিতীয়দিনে র‌্যাবের তিন সদস্য আদালতে জবানবন্দি দিলেন।

সিও বলেছিল, কারও কিছুহবে না, ডোন্ট ওয়ারি: আদালতে জবানবন্দি দিতেগিয়ে হাবিলদার এমদাদুল হক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, নির্দেশ না মানলে আমাদেরহত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছিলো। সিও তারেক সাঈদ বারবার বলেছিলো, এতেওপর মহলের নির্দেশ রয়েছে, কারও কিছু হবে না। ডোন্ট ওয়ারি।আদালতের একটিসূত্র জানায়, তিনজনের জবানবন্দি হুবহু একই। জবানবন্দি দেয়ার সময় কেঁদেছেনতিনজনই। তিন জনই বলেছেন, ২৭ এপ্রিল ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে ৭ জনকেঅপহরণের নেতৃত্ব ও তদারকি করেন র‌্যাব-১১ এর কার্যালয় কোম্পানি কমান্ডারএমএম রানা। অপহরণ শেষে ৭ জনকে প্রথমে আনা হয় কালীবাজার কার্যালয়ে। সেখানথেকে রাতে তুলে দেয়া হয় আদমজী র‌্যাব-১১ মূল কার্যালয় র‌্যাব-১১ এর সিওতারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও মেজর আরিফের কাছে। সেখান থেকে তারেক সাঈদ ও মেজরআরিফ অপহৃতদের নিয়ে যান নরসিংদীতে। গাড়িতেই তাদের কোরিয়ান একটি চেতনানাশকইনজেকশন দেয়া হয়। পরে আদামজী র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে এনে সবাইকে শ্বাসরোধ করেহত্যা করা হয়। ওই কার্যালয়ে বস্তায় ইট ভরে কমান্ড গিঁট দিয়ে লাশ বাঁধা হয়।পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় নূর হোসেনের বালু সাম্রাজ্য কাঁচপুর সেতুর নিচে। ওইসময় সেখানে র‌্যাব-১১ সিও তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, মেজর আরিফ ও এমএম রানাউপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে মেজর আরিফ বারবার চেয়ারম্যান সাহেব বলে মোবাইলেকথা বলছিলেন (নূর হোসেনকে চেয়ারম্যান নামে ডাকা হয়)। কাঁচপুর ব্রিজের নিচেআগ থেকেই অপেক্ষারত ছিলো দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সেই নৌকায় করেই ৭ জনের লাশশীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকার মোহনায় নিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
তারাআরও জানান, সাতজনকে হত্যার সময় নিম্ন পদস্থ র‌্যাব সদস্যরা কাজটা ঠিক হচ্ছেনা বলে মৃদু প্রতিবাদ করেছিলো। সেই সময় তারেক সাঈদ প্রতিবাদকারীদের শাসিয়েবলেন, যে বেশি কথা বলবে তার পরিণতি এমনই হবে।

সূত্রটি আরও জানায়, ৩০এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ভেসে উঠলে আঁতকে ওঠেন তারেক সাঈদ। আদমজী অফিসেকিলিং মিশনে থাকাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। সেখানে লাশ বেঁধেছিলো যারাতাদের শাসানো হয়। লাশের ওজনের সাথে সঙ্গতি রেখে ইট বাঁধা হয়েছিলো কি-না তাজিজ্ঞাসা করা হয়। নির্দিষ্ট একটি লাশের ওজন মেপে লাশের সাথে ইট বাঁধলে লাশতো ভাসার কথা নয় বলে তারেক সাঈদ জবাবদিহি চান সবার কাছে। এ সময় অনেকে বলে, লাশ ঠিকমতোই বাঁধা হয়েছে। তাহলে কিভাবে ভাসলো?কেউ কোনো উত্তর না দেয়ায়তিনি ক্ষেপে যান। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় দফাবৈঠক ডেকে তারেক সাঈদ সবাইকে বলে দেন যে, কারও সাথে কোনো কিছু নিয়ে মুখখোলা যাবে না। যে মুখ খুলবে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে।

জবানবন্দি শেষে বিকেল৪টা ৫০ মিনিটে তিনজনকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ওই তিনজনের সাথে রিমান্ডেনেয়া এবি কর্পোরাল আরিফ হোসেন (নৌবাহিনী) ও লে. কর্পোরাল বেল্লালহোসেনকে (আনসারবাহিনী) যেকোনো সময় আদালতে হাজির করা হতে পারে।