সালাহউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল

২৩টির মধ্যে ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত ৫টি অভিযোগে ৭০ বছরের জেল

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপিকে গণহত্যা, হত্যা, সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরিত করাসহ চারটি অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া অপহরণ ও নির্যাতনের পাঁচটি অভিযোগে তাকে ৭০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে বলা হয়েছে, সালাহউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যার ৩ নম্বর, সুলতানপুর বণিকপাড়ায় গণহত্যার ৫ নম্বর, উনসত্তরপাড়ায় গণহত্যার ৬ ও তত্কালীন আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মোজাফফর আহমেদকে অপহরণের পর হত্যার ৮ নম্বর অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেকটিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া গহিরা গ্রামে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়ায় হত্যাকাণ্ডের ২ নম্বর, জগত্মল্লপাড়ায় হত্যাকাণ্ডের ৪ নম্বর এবং রাউজান পৌরসভা এলাকার সতীশ চন্দ্র পালিত হত্যার ৭ নম্বর অভিযোগের প্রত্যেকটিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০ বছর করে ৬০ বছর এবং নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ ও নির্যাতনের ১৭ এবং মো. সালেহউদ্দিনকে অপহরণ ও নির্যাতনের ১৮ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর করে ১০ বছর করাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় গুডস হিলে সাতজনকে অপহরণ করে নির্যাতনের ১ নম্বর, মানিক ধরের বাড়িতে লুটপাটের ১০ নম্বর, বোয়ালখালী গণহত্যার ১১ নম্বর, বিজয় কৃষ্ণ ও দুইজনকে হত্যার ১২ নম্বর, হানিফ হত্যার ১৪ নম্বর, মাহবুব আলম হত্যার ১৯ নম্বর, এখলাস হত্যার ২০ নম্বর ও সলিমুল্লাহর উপর নির্যাতনের ২৩ নম্বর থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ এবং ২২ নম্বর অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির না করায় ট্রাইব্যুনাল এসব অভিযোগ থেকে সালাহউদ্দিন কাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছেন। রায়ের আদেশে বলা হয়, প্রতিটি অভিযোগে আলাদা আলাদা দণ্ড প্রদান করা হলেও মৃত্যুদণ্ড যখন কার্যকর হবে তখন সকল সাজা স্বাভাবিক নিয়মে একীভূত হয়ে যাবে। তবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন। রায় ঘোষণার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া তার স্ত্রী, দুই ছেলে, মেয়ে, বোন, ভাই ও ভাতিজাসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবী, কয়েকজন সাক্ষী, পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এজলাস কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে ন্যায় বিচার না পাওয়ার দাবি করেছেন সালাহউদ্দিন কাদেরের আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যরা। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও সাধারণের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিলেন তা ছিল অভাবনীয়। এটি সঠিক বিচার হয়েছে। যেসব পরিবারের ওপর তিনি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন ৪২ বছর পরে হলেও তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন।

তবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেছেন, এ রায় ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হবে। একই কথা বলেছেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সহধর্মিণী ফারহাত কাদের চৌধুরী। রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এটি জুডিসিয়াল কিলিং। আমরা মামলার রায়ের কপি একদিন আগেই কয়েকটি ওয়েবসাইটে পেয়েছি। জানতে পেরেছি, এ কপি আইন মন্ত্রণালয় তৈরি করেছে। আমরা হতবাক হয়েছি যে, আইন মন্ত্রণালয়ের রায়ের কপি কীভাবে বিচারকরা পড়তে পারেন। অন্যদিকে, রায় পড়ার সময় বিচারকদের উদ্দেশে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, দুদিন ধরে অনলাইনে এ রায় পাওয়া যাচ্ছে। এটা পড়ার তো দরকার নেই! রায় ঘোষণার পরপরই তিনি বলেন, এই রায় আইন মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়েছে। এ জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিচ্ছি। তবে আসমিপক্ষের এ দাবি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, রায় ঘোষণার আগে প্রকাশের প্রশ্নই ওঠে না। এটা অনুমান নির্ভর।

গতকাল মঙ্গলবার সালাহউদ্দিন কাদেরের রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালসহ সুপ্রিম কোর্টের আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। জনাকীর্ণ এজলাসে বেলা ১০টা ৪২ মিনিটে কাঠগড়ায় আনা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। এর মিনিট খানেক পর বিচারকরা আসন গ্রহণ করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। মোট রায় ১৭২ পৃষ্ঠার তবে রায়ের একটি সারাংশ পড়া হবে।’ এর পর একে একে বিচারপতি আনোয়ারুল হক, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর রায়ের সারাংশ পড়েন। ১০টা ৪৬ মিনিট থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত রায় পড়া হয়।

এর আগে ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে আনা হয় সালাহউদ্দিন কাদেরকে। কাঠগড়ায় সব সময় তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। তিনি বিভিন্ন মন্তব্যও করছিলেন। ৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ৩০ লাখ তো মারা গেছে। বলে দিলেই হয় আমি ২০ লাখ মেরেছি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, রায় তো গতকালই ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, এ রায় এখান থেকে হয়নি। এই রায় বেলজিয়াম থেকে এসেছে।

বিচারপতি আনোয়ারুল হক রায় পড়ার সময় বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তখন তিনি বলেন, নো ৬ বার। আচ্ছা যেহেতু ৫ বার লিখছেন তাহলে থাক আর পরিবর্তন করতে হবে না। এর কিছুক্ষণ পড়েই নিচু কণ্ঠে বলেন, মানুষ ৬ বার আমাকে রায় দিয়েছে, এখানে কি রায় দেবে। আর রায় পড়ার দরকার নেই। বাকিটা আমরা ওয়েবসাইটে দেখে নেবো।

আনোয়ারুল হকের পর বেলা ১১টা ৫১ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের বলেন, আমাকে ইলেকশন করতে না দেয়ার জন্য কতো কষ্ট করছেন তারা। বিএনপিতে যোগ দেয়াটাই আমার কবীরা গুনাহ। রায় পড়ার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, সংসদ চলাকালে আমার বিরুদ্ধে কোনো বিচার কার্যক্রম চলতে পারে না। এখন যা চলছে তা অবৈধ, কারণ এখন সংসদ চলছে।

রায়ে সাফাই সাক্ষীর প্রসঙ্গ এলে তিনি বলেন, আমি নাকি সাক্ষী আনতে ফেল করেছি। আমি এক হাজার দুশ সাক্ষীর তালিকা দিয়েছি। তার মধ্যে ৫ জনের অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টের একজন সিটিং জজও সাক্ষী দিতে চেয়েছেন। তাকে কেন সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয়নি? এর আগে সকাল ১০টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে প্রিজনভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। শিশু একাডেমীর পাশে ট্রাইব্যুনালের গেট দিয়ে তাকে ঢোকানো হয়। এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে হাত নাড়েন তিনি। সেখান থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেয়া হয়।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর এ নিয়ে সাতটি মামলার রায় ঘোষণা করা হল। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে তিনটি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে চারটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে জামায়াতে ইসলামীর বহিষ্কৃত রুকন পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আর জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ৯০ বছর ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তবে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল-২ এ আরো তিনজনের মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণ: সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায়ে বিশেষ কোনো পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেননি ট্রাইব্যুনাল। তবে তার আচরণের তিনটি বিষয় পর্যবেক্ষণ হিসাবে রায়ে উল্লেখ করা হল। প্রথমত বিচারের প্রাথমিক পর্যায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালতের আচরণ (কোর্ট ডিমিনর) ভঙ্গ করে অস্বাভাবিক আচরণ করতেন। দ্বিতীয়ত, ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা আদালতে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় এজলাসে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী অনেক সময় তা করতেন না। তৃতীয়ত, ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের তিনি (সাকা চৌধুরী) চেয়ারম্যান সাহেব, মেম্বার সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য। তার এমন আচরণ কখনোই কাম্য হতে পারে না। আইনপ্রণেতা হলেও তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। তবে বিচারের ক্ষেত্রে এসব বিষয় কোনো প্রভাব ফেলেনি।

ট্রাইব্যুনালকে স্বীকৃতি দিতে চাননি সালাহউদ্দিন কাদের: সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্বীকৃতি দিতে চাননি। ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রমে দীর্ঘকাল তিনি নিজের পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেননি। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে তিনি প্রায়ই বলতেন, ফাঁসিতো দেবেনই, সময় নষ্ট করার কি দরকার। শুরু থেকেই ট্রাইব্যুনালের প্রতি তার আস্থা ছিলো না। তিনি ট্রাইব্যুনালকে কখনো আদালত বলে সম্বোধন করেননি। সব সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের চেয়ারম্যান, মেম্বার সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। এছাড়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দাবি সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যে অংশ নিতে পারেন না। তিনি সংবিধানের ৯৪ এর ৩ ধারা উল্লেখ করে বলেছিলেন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারকরা কেবল সুপ্রিমকোর্টে আসন গ্রহণ করবেন।

সাফাই সাক্ষীরা যা বলেছিলেন: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গঠনের পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এক হাজার ১৫৩ জনের নাম জমা দেয়া হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাফাই সাক্ষীর সংখ্যা ৫ জনে নির্ধারণ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। সালাহউদ্দিন কাদের ছাড়াও তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সাফাই সাক্ষ্য দেন। তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সালাহউদ্দিন কাদের বাংলাদেশে ছিলেন না। দ্বিতীয় সাক্ষী নিজাম আহমেদ সাক্ষ্যে বলেন, একাত্তরে ২৮ মার্চ কাইয়ুম চৌধুরী ও আমি ধানমণ্ডির ৮ নম্বর রোডে (পুরাতন) অবস্থিত সুইডিস পরিবারের বাসায় উঠি। ওই বাসায় থাকার সময় সালাহউদ্দিন কাদেরকে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে রেখে আসার কথা জানিয়েছিলো কাইয়ুম। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ৭ কিংবা ৮ তারিখে কাইয়ুম, সালমান এবং আমি একই বিমানে করে করাচিতে গিয়ে সালমানের বাসায় উঠি। সেখানে দু বা একদিন পরে সালাহউদ্দিন কাদের আমাদের দেখতে আসে। পরে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল কিংবা মে মাসে ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে সালাহউদ্দিন কাদেরের সাথে আমার দেখা হয়। তৃতীয় সাফাই সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেন ব্যবসায়ী কায়ুম রেজা চৌধুরী। তিনি সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তার বাসা থেকে গাড়িতে তুলে তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে দেই। ওই বছরের ১০ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের করাচিতে সালমান এফ রহমানের বাসায় এসেছিলেন। তবে সেদিন আমি বাইরে থাকায় তার সাথে আমার দেখা হয়নি।

আর চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমিন চৌধুরী (৭৪)। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে করাচিতে থাকার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে পরিচয় হয়। সালাহউদ্দিনের আইনজীবীদের দাবি, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন না এবং সাফাই সাক্ষীদের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত হয়েছে।

মামলার বিচার প্রক্রিয়া: ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ১৭ নভেম্বর তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ তার বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে একাত্তরের ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নতুন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ড; চট্টগ্রামের মধ্য গহিরা, জগত্মল্লপাড়া, সুলতানপুর বণিকপাড়া, ঊনসত্তরপাড়া, শাকপুরা প্রভৃতি গ্রামে গণহত্যার অভিযোগ। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অনুসারে, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি গুডস হিল একাত্তরে ছিলো একটি নির্যাতন কেন্দ্র। অনেক ব্যক্তিকে সেখানে ধরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।

ওই বছরের ১৪ মে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস ধরে চলা সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ২৪ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ৪১ জন। এছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে চারজন সাক্ষীর দেয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র চারজন। ২৮ জুলাই থেকে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়, ১৪ আগস্ট শেষ হয়।

ট্রাইব্যুনাল ঘিরে কড়া নিরাপত্তা: সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল ট্রাইব্যুনাল ও আশপাশ এলাকায় কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। রায়কে ঘিরে গোটা এলাকায় যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। দোয়েল চত্বর এলাকা, কার্জন হল ও বঙ্গবাজার সংলগ্ন রাস্তা, কদম ফোয়ারা রাস্তা আটকে দেয়া হয়। পুরানো হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইব্যুনালের দুটি ফটকেই অর্ধশতাধিক ৱ্যাব ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত ছিলেন।

আইনজীবী ছিলেন যারা: রাষ্ট্রপক্ষে সালাহউদ্দিন কাদেরের মামলা পরিচালনা করেন- প্রসিকিউশনের প্রধান সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এমকে রহমান, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, রানা দাস গুপ্ত, জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ, একেএম সাইফুল ইসলাম, আব্দুর রহমান হাওলাদার, তুরিন আফরোজ, নূরজাহান বেগম মুক্তা, রেজিয়া সুলতানা বেগম, তাপস কান্তি বল। অন্যদিকে আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন- এএইচএম আহসানুল হক হেনা, একেএম ফখরুল ইসলাম, মুহাম্মদ হুজ্জাতুল ইসলাম খান, সালমা হাই টুনি (রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী)।