সাতছড়ির পাহাড়ে সুড়ঙ্গের সন্ধান : উল্টো পাশে ওয়াচ টাওয়ার

 

স্টাফ রিপোর্টার:ঝোপঝাড়ে ভরা। মাঝেকবরের মতো গর্ত। ওপর বাঁশের মাচা। প্রথমে কবর বলে মনে হলেও আসলে ওটা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের মুখ। সাতছড়ির বনে একটিপাহাড়ে এ সুড়ঙ্গের সন্ধান মিলেছে। সমতল থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরেএকটি সুউচ্চ পাহাড়ে রয়েছে এ সুড়ঙ্গটি। দীর্ঘ এ সুড়ঙ্গের শেষ কোথায় তা জানাযায়নি। তবে কোনো এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যবহারের জন্য এ সুড়ঙ্গ পথতৈরি করেছিলো বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুড়ঙ্গের উল্টো পাশে একটি ওয়াচ টাওয়ারওদেখা গেছে। গতকালশনিবার অনুসন্ধানে ওই পাহাড়েপাশাপাশি ঝোপঝাড়ে ঘেরা কয়েকটি পরিত্যক্ত বাড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে। এসববাড়িতে পুরনো আসবাবপত্র, ওয়াকিটকির ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিভিন্নকীটপতঙ্গের শব্দে গহিন বনে গা ছমছম করা আতঙ্ক। এর মাঝেই অন্তত ২০টি ছোট-বড়পাহাড় টপকে সন্দেহজনক ওই পাহাড়ে পৌঁছানো হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, এক সময় এখান এসে পলাতক জীবনযাপন করতো সমমনাভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। এদিকে সমরাস্ত্র ওগোলাবারুদ উদ্ধারের পর সাতছড়ির পাহাড়ে-পাহাড়ে এখন শুধুই আতঙ্ক। এসব স্থানেবসবাসকারী উপজাতীয়রাও পাহাড় ছেড়ে চলে গেছেন অজ্ঞাত স্থানে। আতঙ্কেসাতছড়িমুখী হচ্ছেন না পর্যটকরাও। এ প্রসঙ্গে র‌্যাব-৯ এর শ্রীমঙ্গলক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সানা শামীনুর রহমানবলেন, অভিযান চলছে। পার্শ্ববর্তী সন্দেহভাজন টিলাগুলোতেও অভিযানচালানো হবে। যতোক্ষণ পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধারের সম্ভাবনা থাকবে ততোক্ষণপর্যন্ত অভিযান চলবে।’ গত ২ দিনে নতুন কোনো অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নিজানিয়ে তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের আতংকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যথেষ্টনিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।’

গতকাল শনিবার গভীর বনে একটি পাহাড়ে সরেজমিনগিয়ে দেখা গেছে পাহাড়ের উঁচুতে বালুর বস্তা দিয়ে তৈরি করা নিরাপত্তাবেষ্টনী। অপর পাশে ওয়াচ টাওয়ার। মাঝে সুড়ঙ্গ মুখ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরসদস্যদের মতে পাহাড়ের এ স্থানগুলো প্রতিপক্ষের আক্রমণ রোধে ব্যবহার হয়েথাকতে পারে। এ পাহাড়ে যা দেখা যাচ্ছে তার সব কিছুই প্রতিরক্ষার জন্য তৈরিকরা হয়েছিলো। ওয়াচ টাওয়ার থেকে শত্রুপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা হতো। সুযোগবুঝে নিরাপত্তা বেষ্টনী থেকে শত্রুর ওপর হামলা চালানো, সর্বশেষ পেরে নাউঠলে আত্মরক্ষায় সুড়ঙ্গ দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পলায়ন। তাদের মতে, সুড়ঙ্গবা নিরাপত্তা বেষ্টনী এতো পুরনো যে কাছে গেলে বড় কোনো যুদ্ধের কথা মনে করিয়েদেয়। এগুলো এক সময় শান্তিবাহিনীর সদস্যরাও ব্যবহার করে থাকতে পারে। আবারযে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের লোকজনও এসে আস্তানা গাড়তে পারে। একটি ঘরেরয়েছে বড় ধরনের চারটি চুলা ও ডাইনিং হল। এ থেকে অনুমান করা যায়, এক সময়েঅনেক লোকের সমাগম হতো এ পাহাড়ে। র‌্যাব বলেছে, তারা ধীরে ধীরে প্রতিটিসন্দেহভাজন পাহাড়ে অনুসন্ধান চালাবে। শনিবারও লাল টিলায় র‌্যাবের কয়েকজনসদস্য ইতিপূর্বে শনাক্ত করা সাতটি বাংকারের খোঁড়াখুঁড়ি করছিলো। এ পাহাড়থেকেই রোববার ও সোমবার র‌্যাব সদস্যরা বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র এবং গোলাবারুদউদ্ধার করে। র‌্যাব সদস্যরা ওই পাহাড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
স্থানীয়পাহাড়ি ও সমতল জনগোষ্ঠীর বয়স্ক অধিবাসীদের সাথে কথা বলে ও বিভিন্ন সূত্রেখোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহু আগে সাতছড়ির গহিন অরণ্যে তৎপর ছিলো ভারতীয়বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ১৩টি সংগঠন। এগুলো হচ্ছে, ত্রিপুরা পিপলস ডেমোক্রেটিকফ্রন্ট (টিপিডিএফ), ট্রাইবাল ফোর্স, ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এনএলএফটি), ত্রিপুরা কিংডম, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ), অল ত্রিপুরাটাইগার ফোর্স (এটিটিএফ), রয়েল বরাক আর্মি (আরবিএ), ইউনাইটেড লিবারেশন অবআসাম (আলফা), পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ও প্রিপাক।
তাদের মতে, একইসময়ে সিলেটের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ও নয়াপত্তন এলাকায় তৎপরতা ছিলো ভারতীবিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিপলস রিপাবলিকান আর্মি (পিএলএ) এবং প্রিপাকের।ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশী অংশে কোর্মা চা বাগানের অদূরেত্রৈলং বাড়ি এলাকায় তৎপর ছিলো ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এনএলএফটি), অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স এটিটিএফ এবং ইউনাইটেড লিবারেশন অবআসামের (আলফা)। কুলাউড়ার ইকোপার্ক ও লাঠিটিলা এলাকায় দুটি ক্যাম্প ছিলোএটিটিএফ, এএলএফএটি, এনএলএফটির। সিলেট শহরের মনিপুরি পাহাড়গুলোতে (১৩টিপাড়া) ছিলো দু বিচ্ছন্নতাবাদীদের ঘাঁটি। জাফলং খাসিয়া পল্লিতে স্টেশন ছিলোএটিটিএফ, আলফা, এনএলএফটির ঘাঁটি। গোয়াইনঘাট নিরলা পুঁঞ্জিতে ছিলো এটিটিএফ, আলফা, এনএলএফটির ঘাঁটি। কমলগঞ্জের বখতিয়ারখোলা গ্রামে ছিলো পিএলএ, প্রিপাক, মনিপুরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জঙ্গি সংগঠন। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্যদেরমাতৃভাষা হচ্ছে ককবরক। আলফা পিপলস লিবারেশন আর্মি ও প্রিপাক নামে দুটিসংগঠনের সদস্যদের মাতৃভাষা হলো মৈতৈলোন। এভাষা বাংলাভাষাবাসীদের বোঝার কোনোউপায় নেই। এ ভাষা বোঝে শুধু তাদের জনগোষ্ঠী। ত্রিপুরাসহ পাহাড়ি আদিবাসীরাতাদের এসব ভাষা বোঝে। আর এ কারণেই তারা এ অঞ্চলগুলোকে নিজেদের আস্তানাহিসেবে বেছে নেয়। সাতছড়িতে ত্রিপুরা আদিবাসীদের একটি পুরনো আবাসস্থল। তাই এঅঞ্চলকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। গড়ে তুলেছিল মূলআস্তানা। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম।অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ভারতের ওপার থেকে এখানে লোকজনকে অপহরণকরে এনে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। ছোট-বড় টর্চার সেলে রেখে করা হতো নির্যাতন।এগুলো ঘটতো অনেক আগে। বিশেষ করে দু’হাজার পাঁচ থেকে দু’হাজার সাত সালের পরথেকে সব পরিষ্কার। এরপর কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদেশি কোনো সন্ত্রাসীবাহিনীর আনাগোনা নেই। কাউকে ধরে এনে মুক্তিপণের জন্য বন্দি করেও রাখা হয়না।সরকারের একটিগোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছে, ২০০৩ সালের ২৬জুন বগুড়ার কাহালুতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ ট্রাক আটকের পর আলোচনায় আসেসাতছড়ির নাম। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটির খবর নিশ্চিত হয়ে পুলিশ ও তৎকালীনবিডিআর সাতছড়িতে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। ওই সময় সন্দেহভাজন ১৩বিচ্ছিন্নতাবাদীকেও গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ীব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েও পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআর অস্ত্রের ঘাঁটি চিহ্নিতকরতে পারেনি। ওই সময় র‌্যাবের তৎকালীন কর্মকর্তা বিডিআর বিদ্রোহে নিহতকর্নেল গুলজারের নেতৃত্বে অভিযানটি পরিচালিত হয়। ওই অভিযানে একটি বাংকারেরসন্ধান মিললেও সেখানে একটি বড় টেলিভিশন ছাড়া আর কিছু মেলেনি।