সরকারি সুবিধা পাবেন না প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা

নির্বাচনী কাল অর্ধেক করে ফেলেছে ইসি

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনকালীন আচরণবিধির খসড়া অনুমোদন তফসিল ঘোষণার পর রুটিন কাজ করবে সরকার। ব্যবহার করা যাবে না সরকারি প্রচারযন্ত্রও। বিধি লংঘন করলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাসের দণ্ড। সংবিধানের প্রদত্ত নির্বাচনীকাল কমিয়ে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিদ্যমান আইনেও নির্বাচনকাল ছিলো ৯০ দিন। এখন তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচনের কাল গণনা হবে। সাধারণত ৪২ থেকে ৪৫ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর ফলে নির্বাচনকালের প্রায় অর্ধেক সময় কমে যাবে।

তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সরকারের সুবিধাভোগীরা যাবতীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে নির্বাচনী তত্পরতা চালাতে পারবে। এছাড়া তফসিল ঘোষণার পরেও সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব এবং এ সংক্রান্ত সভায় যোগদান করতে পারবেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের পরই একজন প্রার্থী হিসেবে গণ্য হন। সাধারণত তফসিল ঘোষণার ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়ে থাকে। তবে তফসিল ঘোষণার পর সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী বা সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তিই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারবেন। যদি সেই সফর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য নয়, সরকারি সফর হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত বিধান সংযুক্ত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ (সংশোধন) বিধিমালা, ২০১৩ খসড়া অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর এ বিধির কোনো ধারা লংঘন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

গতকাল বুধবার কমিশন সভায় এ আচরণবিধির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজকালের মধ্যে আচরণবিধির খসড়া কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। সাতদিনের মধ্যে নাগরিকদের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে এ আচরণবিধি। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে আচরণবিধিতে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের গেজেট হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকার কেবল রুটিন কাজ করবে। কোনো নীতি-নির্ধারণী বা সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর প্রশাসনে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা রদবদল আনতে হলে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ নিতে হবে। কিন্তু রুটিন ওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়টি আচরণবিধিতে উল্লেখ নেই। বরং সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এ সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।

খসড়া আচরণবিধিতে নির্বাচন পূর্ব সময়ের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে নব্বই দিনের স্থলে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২ ধারায় (চ) উপধারায় নির্বাচন পূর্ব সময়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন বা কোনো আসনের উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন ঘোষিত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেট প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল। এ বিধান হলে নির্বাচনী আচরণবিধি ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মতো কার্যকর থাকবে। বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী আচরণবিধি ৯০ দিন বা তার বেশি সময় কার্যকর থাকার কথা। আগের আচরণবিধিতে নির্বাচনপূর্ব সময় বলতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ বা সংসদ ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ফল গেজেটে প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়কে বুঝানো হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী নির্বাচনপূর্ব সময়ে আচরণবিধি কার্যকর থাকবে। ২০০৮ সালে আগের এ বিধান করা হয়েছিলো।

তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনী প্রচারণা যাতে না হয়, সেজন্য এ বিধান করা হয়। কিন্তু বিধানটি করা হয়েছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির আলোকে। তাছাড়া আগের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সংসদের মেয়াদ শেষে। তবে বর্তমান সংবিধান নির্বাচনকাল বলতে ৯০ দিন বোঝানো হয়েছে। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিন এবং কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরের ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু আচরণবিধিতে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

খসড়া আচরণবিধির ১৪ ধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনী প্রচারণা শিরোনামে বলা হয়েছে-(১) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ তাদের সরকারি কর্মসূচির সাথে নির্বাচন কর্মসূচি যোগ করতে পারবেন না। (২) তাদের নিজেদের বা অন্যদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যান, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না এবং সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যবহার করতে পারবেন না। (৩) কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব অথবা এ সংক্রান্ত সভায় যোগ দিতে পারবে না। (৪) কোনো প্রার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে আগে মনোনীত হলে নির্বাচন পূর্ব সময়ে তা অকার্যকর থাকবে। (৫) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ভোট দেয়া ছাড়া ভোটের দিনে নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রবেশ বা নিজে প্রার্থী না হলে ভোট গণনার সময়ে গণনা কক্ষে প্রবেশ বা উপস্থিত থাকতে পারবেন না।

খসড়া বিধিমালায় ২ ধারায় নতুন একটি উপধারা (ত) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, উপদেষ্টা, বিরোধী দলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী ও সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।

খসড়া আচরণবিধিতে ৩ ধারায় কোন প্রতিষ্ঠানে চাঁদা, অনুদান ইত্যাদি, প্রধান নিষিদ্ধ শিরোনামের প্যারায় নতুন (ক) উপধারা তৈরি করে বলা হয়েছে নির্বাচনের পূর্ব সময়ে কোনো সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অথবা ফলক উন্মোচন করা যাবে না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সার্কিট হাউজও ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়াও খসড়া আচরণবিধিতে প্রার্থীর নির্বাচনী পোস্টারের আয়তন কিছুটা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যানারের আয়তন শাদা-কালো এবং এক মিটার বাই ৩ মিটার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। পোস্টারে বা ব্যানারে প্রার্থী তার প্রতীক ও নিজের ছবি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক ছাপাতে পারবেন না। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও মুদ্রণের তারিখ বিহীন কোনো পোস্টার লাগাতে পারবে না। প্রচারণার ক্ষেত্রে যে সব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা হলো অর্থ, কাগজ, কাপড়, ডিজিটাল ডিসপ্লেবোর্ড বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমসহ অন্য যেকোনো মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত কোনো প্রচারপত্র, প্রচারচিত্র, বিজ্ঞাপনপত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র; এবং যেকোনো ধরনের ব্যানার বা বিলবোর্ড ইত্যাদি। তবে আচরণবিধি লংঘনের শাস্তির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। অর্থাৎ এ বিধিমালার কোনো বিধান লংঘন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিষয়টি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।