সমঝোতার পথে আসতে নির্বাচন বাতিলের দাবি

স্টাফ রিপোর্টার: সমঝোতার পথে আসতে নির্বাচন বাতিল ও সরকারকে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল এক বিবৃতিতে সরকারের প্রতি তিনি এ আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, আমাকে গৃহবন্দি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে সঙ্কটের কোনো সুরাহা হবে না। অবৈধ সরকার দীর্ঘায়িত হবে না দাবি করে ও দেশবাসীকে সংগ্রামে অটল থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জনগণের এ আন্দোলন বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং থাকবে। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যেতে ও আন্দোলনে সব রাজনৈতিক দল, শক্তি ও ব্যক্তির প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে স্বৈরশাসনের কারণে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে মন্তব্য করে তিনি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবাধ অনুশীলনের পক্ষে বিশ্ববিবেককে সোচ্চার ও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। বিবৃতির শুরুতেই নির্বাচনের নামে কলঙ্কময় প্রহসন বর্জন করায় দেশবাসীর প্রতি তিনি অভিনন্দন জানান।

বিবৃতিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারির কলঙ্কময় প্রহসনের মাধ্যমে সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থাই কেবল নয়, প্রমাণ হয়েছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ছাড়া বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। কাজেই অবিলম্বে নির্বাচনের নামে এই প্রহসন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, আমি আবারও বলতে চাই, আমাকে কার্যত গৃহবন্দি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে, বিরোধীদল ও জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে সমস্যা ও সঙ্কটের কোনো সুরাহা হবে না। সন্ত্রাসের পথে অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার অপচেষ্টাতেও শেষ রক্ষা হবে না। বরং তাতে সঙ্কট আরও জটিল, গভীর ও সমাধানের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

খালেদা জিয়া বলেন, অভিনন্দন বাংলাদেশ। অভিনন্দন বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে। আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক ও ভোটারদের। তারা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে কলঙ্কময় প্রহসনকে বর্জন করেছেন। তিনি বলেন, দেশের এবং সারা দুনিয়ার মানুষ নিজের চোখে সরাসরি ও মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছেন। জেনেছেন, কিভাবে ভোটাররা এ কারসাজির ঘৃণ্য প্রহসনকে বর্জন করেছেন। সারাদিন সারাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলো ছিলো ফাঁকা। ভোটারবর্জিত এ একতরফা কারসাজিকে জনগণ ঘৃণাভরে পুরোপুরি বর্জন করেছেন। গণতন্ত্র হত্যার এ যজ্ঞে তারা সায় দেননি। প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামী লীগের এ নির্লজ্জ মহড়াকে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকারের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করার বিপক্ষে অতীত ঐতিহ্যের ধারায় আরেকবার নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন। খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনী প্রহসনে আওয়ামী লীগেরও বিপুলসংখ্যক লোক শরিক না হওয়ায় আমি তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, তারাও জনগণের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের সঙ্গেই একাত্ম থাকবেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ভোটারশূন্য এ নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সকলের সামনে হাতে-কলমে প্রমাণিত হয়েছে, সরকারের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও অনাস্থা কত তীব্র। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের মুষ্টিমেয় দোসর ও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের গণবিরোধী কুকর্মও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সব খানে সারা দিন ভোটকেন্দ্রগুলো শূন্য পড়েছিলো। কেউ ভোট দিতে আসেনি। বহু ভোটকেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। কোথাও কোথাও দু-চারটা করে ভোট পড়লেও এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো জাল। ভোটগ্রহণের শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ছোটাছুটি ও তৎপরতার পর রাতে লাখ লাখ এবং হাজার হাজার ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। এতে পুরো প্রহসনটির সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্যতাও আর অবশিষ্ট থাকেনি। বিরোধী জোট নেতা বলেন, গায়ের জোর, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রশক্তির নিষ্ঠুর অপব্যবহার করে এই প্রহসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে পরাজিত এবং গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে তাদের শাসনক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চাইছে। কতোটা নির্লজ্জ হলে তারা এরপরেও বলতে পারে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। তারা দেশ পরিচালনায় জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে গেছে।
খালেদা জিয়া বলেন, মানুষের কোনো ভোট বা সম্মতি ছাড়াই আগেই জাতীয় সংসদের ১৫৩টি আসন আওয়ামী লীগ ভাগ-বাটোয়ারা করে সিলেকশন করেছে। বাকি ১৪৭ আসনেও ভোটারদের সমর্থন দূরে থাক, তারা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের হাজিরই করতে পারেনি। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ তাদের এই কারসাজির একতরফা অপপ্রয়াসকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই এই সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার আর কোনো নৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। জনগণের অনুমোদন ছাড়া দেশ পরিচালনার এখতিয়ার কারও থাকে না। তিনি বলেন, কারসাজি ও প্রহসনের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছেন। তাদের এই আত্মদান বৃথা যাবে না। ব্যক্তি-বিশেষের ক্ষমতার উৎকট বাসনা যেভাবে রক্ত ঝরাচ্ছে, যেভাবে মানুষ নিজের দেশের সরকারের হাতেই সীমাহীন উৎপীড়িত হচ্ছে, এটা বেশি দিন চলতে পারে না। জনগণের এ আন্দোলন বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং থাকবে। কেন্দ্র থেকে যখন যে কর্মসূচি ঘোষণা হবে তা পালন এবং স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ও সমন্বয় করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এ আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য আমি সকল রাজনৈতিক দল, শক্তি ও ব্যক্তির প্রতিও আহবান জানাই। খালেদা জিয়া বলেন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমি আবারও আহবান জানাই। বেআইনি কার্যকলাপ ও হত্যা-নির্যাতন থেকে বিরত থাকুন। সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করুন। জনগণের সঙ্গে থাকুন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহ সহ সকল নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি আমার কিছু বলার আছে। আজ বাংলাদেশে জনগণের সকল অধিকার ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম স্তব্ধ। সংবাদ-মাধ্যম শৃঙ্খলিত। আগের বারের আওয়ামী শাসনামলে সৃষ্ট যে জঙ্গিবাদকে আমরা ধর্মপ্রাণ মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কঠোর হাতে দমন করতে পেরেছিলাম। আজ আবারও স্বৈরশাসনের কারণে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। এই স্বৈরব্যবস্থা কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্বস্তি ও স্থিতিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবাধ অনুশীলনের পক্ষে বিশ্ববিবেককেও আরও বেশি সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে। খালেদা জিয়া বলেন, সংবাদ মাধ্যম ৫ই জানুয়ারি সারা দিন নির্বাচনী প্রহসনের চিত্র যেভাবে তুলে ধরেছে তার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে রাতে চাপের মুখে তাদের স্বাধীনতা যেভাবে হরণ করা হয়েছে, তার জন্য জানাই সহানুভূতি। আমি সারা দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সকল মিথ্যাচার ও কারসাজিকে মোকাবিলা করে তাদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অটল থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। অবৈধ সরকার দীর্ঘায়িত হবে না ইনশাআল্লাহ।