সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর পরিকল্পনা বাতিল : প্রবাসী ও মহিলাদের জন্য থাকছে বিশেষ স্কিম

 

স্টাফ রিপোর্টার: সাধারণ মানুষের ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ সুদৃঢ় করতে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসা হয়েছে। সরকারের চলতি মেয়াদে সঞ্চয়পত্রের সুদ আর কমছে না। বরং বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পারিবারিক ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ কিছুটা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত আরও ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হতে পারে সঞ্চয়পত্র থেকে। এ লক্ষ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর কথা নতুন করে ভাবছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, শারীরিক প্রতিবন্ধী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং মহিলাদের সঞ্চয়পত্র কিনতে উৎসাহিত করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।

জানা গেছে, ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত এবং ব্যাংক আমানতের ওপর থেকে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করায় ব্যবসায়ী মহলসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসায় আওয়ামলী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর ঘোষণায় অস্থিরতা বাড়ছে এ খাতের সাধারণ বিনিয়োগকারীর মধ্যে। ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ নেই বললেই চলে। ৪-৬ শতাংশ যেটুকু সুদ দেয়া হয় তাও বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে কেটে রাখছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, মহিলা এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এবং স্বল্প আয়ের মানুষ নিজেদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। কিন্তু সুদ কমানোর ঘোষণায় যারা সঞ্চয় করেন তাদের মধ্যে এক ধরনে হতাশা তৈরি হয়। এ অবস্থায় গত কয়েক মাসে রেকর্ড পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। অনেকেই এমএলএম কোম্পানি, বহুমুখী সমিতি এবং ভুয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেশি লাভের আশায় নিজের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করে সর্বস্ব খুইয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছরে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাবর বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তা আর্থিক সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছেন। তাদের বেশিরভাগ আবেদনের মর্ম কথা হচ্ছে: পেনশনের টাকা শেষ, এ অবস্থায় সাহায্য না পেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। তিনি বলেন, অনেকে উচ্চ লাভের আশায় পেনশনের টাকা এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) কোম্পানি এবং ভুয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন, কেউ না বুঝে শেয়ার কিনেছেন আবার কেউ টাকা পেয়েই বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কিনেছেন। এখন তাদের হাতে আর কোনো টাকা নেই। তাই সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কল্যাণে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। তারা না বুঝেই আবেদন করেছেন। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিব্রতবোধ করছে।

তিনি বলেন, তবে এ ঘটনার মধ্যদিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলেরও কিছু বোধোদয় হয়েছে। পেনশনের টাকা পেনশনাররা কোন খাতে বিনিয়োগ করবেন সে বিষয়ে ভবিষ্যতে কিছু গাইডলাইন দেয়া হবে। এক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্র কেনা সবচেয়ে ভাল পলিসি। সরকারের এ খাতে বিনিয়োগ করলে ঘরে বসেই তিনমাস অন্তর অন্তর যে কেউ বিনিয়োগকৃত টাকার মুনাফা পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও কেনা বাড়াতে সবাইকে উৎসাহিত করা হবে।

দেশের মোট জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। এই অর্থনৈতিক স্তরের মানুষের জীবনকে কিছুটা সাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা দিতেই সঞ্চয়পত্র নামের সরকারের এই স্কিম বরাবরই জনপ্রিয় হয়ে আসছে। আর এর বিপরীতে বাড়তি সুদের ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে সরকারকে। সাধারণত, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, অবসরপ্রাপ্তদের সামাজিক নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রির অন্যতম উদ্দেশ্য। জনগণের মাঝে সঞ্চয়ের মনোবৃত্তি গড়ে তোলাও সঞ্চয়পত্রের আরেকটি উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ নেয় সরকার। বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎসের অন্যতম এই সঞ্চয়পত্র। বর্তমান চার ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হচ্ছে।

এদিকে, গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) সঞ্চয়পত্র বিক্রির আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় সুদের হার ৫ শতাংশ। অপরদিকে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। যদিও গত অর্থবছরের ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) ৪২ হাজার ৯৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। শুধু এপ্রিল মাসেই বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। গত বছরের এপ্রিলে বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ২৯৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। সুদ কমানোর ঘোষণায় সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র কেনার হিড়িক পড়ে যায়। বাজেট ঘাটতি মেটাতে গত অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে এ খাত থেকে।