সংলাপের প্রস্তাব আ.লীগের নাকচ জামায়াত ছাড়ছে না বিএনপি

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বান নাকচ করেছে আওয়ামী লীগ। জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বানে এখনই সাড়া দিচ্ছে না বিএনপিও। অপরদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশে জঙ্গি হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। প্রস্তাবগুলো হলো- ১. গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসার আহ্বান, ২. সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন, ৩. আইএসসহ জঙ্গিগোষ্ঠীর ঝুঁকির কথা স্বীকার করা, ৪. নাগরিক সুরক্ষার সুপারিশ এবং ৫. অস্থিরতার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার আহ্বান। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি দমনের ইস্যুকে হালকাভাবে না নিয়ে এ ব্যাপারে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন। ইস্যুটি হালকাভাবে নিলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। সরকারকে শক্ত হাতে জঙ্গি দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। ট্রসবার্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে মঙ্গলবার রাতে প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর এ আলোচনায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়। পূর্বনির্ধারিত এ বিতর্কে মূলত তিনটি বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অর্থবহ সংলাপের আহ্বানে সরকার কোনো সাড়া দেবে কিনা জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বিতর্কের খবর সংবাদপত্রে পড়েছি। আমাদের দলে সংলাপ নিয়ে কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই। সংলাপের প্রশ্নে আমি বলতে চাই, শেখ হাসিনা আলোচনার জন্য খালেদা জিয়াকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করার পর সংলাপের আর কোনো কার্যকারিতা আছে বলে আমার মনে হয় না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের এই সদস্য আরও বলেন, প্রত্যেকটা জিনিসের একটা মুহূর্ত থাকে, টার্নিং পয়েন্ট থাকে। খালেদা জিয়া ওই সময়ে শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিলে ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতে পারত। তখন সংলাপের জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বানের প্রয়োজন হতো না।’

জঙ্গিদের তৎপরতার কথা স্বীকার করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মিলিট্যান্টদের সিক্রেট কিলিং এবং উগ্রবাদী কাজ চলছে। আমরা এ কথা অস্বীকার করি না। আমি মনে করি, সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীদের হুমকি আছে।’ এটা একটা বাস্তব সমস্যা। তবে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সে সম্পর্কে মন্ত্রী বিস্তারিত কিছু বলেননি। জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বানে বিএনপি সাড়া দেবে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, ‘জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আগেও বলেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও এসব কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টি আমরা শুনছি এবং সজাগ আছি। সময় হলে সবকিছুর উত্তর পাওয়া যাবে। তবে আমি এ কথা বলব যে, সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান- বিএনপি যে কোনো সন্ত্রাসকে নিন্দা করে।’ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আলোচনা প্রসাথে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বৃহস্পতিবার বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণেই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট অর্থবহ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। নতুন করে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ বাড়তি হুমকির সৃষ্টি করেছে। এ সমস্যা সমাধানে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে সবাইকে নিয়ে আলাপ করা প্রয়োজন। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া সন্ত্রাস ও সহিংসতা দমন করা সম্ভব নয়। এটাকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। হালকাভাবে নিলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হতে পারে।’

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বিতর্ক সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কিংবা বিদেশীদের বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গি আছে বলে যা বলছে তাতে একটা মোটিভেশন আছে। এটা স্বীকার করে নিলে তারা এখানে আসার একটা সুযোগ পায়। আমরা বলছি, এখানে ইসলামী জঙ্গি নেই, তারা বলছে আছে, তারা জোর করে এটা বলছে। এটা একটা সমস্যা। তারা ইচ্ছা করে বারবার এটা বলছে। সরকার যখন বলছেন যে, আমরা খুঁজে দেখেছি এখানে কোনো আইএস নেই। তারপর আবারও তারা যখন আছে বলে তখন আমরা অবাক হই। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এটা হ্যান্ডেল করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে জঙ্গি তৎপরতা না বাড়ে। কেননা এটাতে দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে’।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস (বিস) চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ‘আমাদের সমস্যা আমাদেরই মেটাতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন। বাইরে থেকে চাপিয়ে দিয়ে পৃথিবীতে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। স্থানীয় লোকদেরই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাইরের হস্তক্ষেপে সমস্যার আরও অবনতি হয়। বাইরের কেউ যদি বন্ধু হিসেবে কোনো সহযোগিতা করতে চায় তবে গোপনে সরকারের কাছে বলা উচিত। প্রকাশ্যে পার্লামেন্টে বলা হলে সরকার মনে করতে পারে যে, তারা কোন পক্ষ নিচ্ছে। এতে কাজের চেয়ে অকাজ বেশি হয়।’

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে মঙ্গলবার বাংলাদেশ স্থানীয় সময় মধ্যরাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর বিতর্কের সূত্রপাত করেন নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্ট কোয়েন্ডার্স। তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসতে হবে। সার্বিকভাবে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এতে করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক স্পেস সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়। আইএসসহ জঙ্গিগোষ্ঠীর ঝুঁকির কথা স্বীকার করতে হবে। অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানানো হয় বিএনপির প্রতি। এসব পালনে বাধ্য করতে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে একটি দাবির সাথে একমত হননি বার্ট কোয়েন্ডার্স।