শিক্ষক দম্পতির একমাত্র কন্যা সন্তানের আকস্মিক অকাল মৃত্যুতে চুয়াডাঙ্গায় শোকের ছায়া

অসুস্থ হওয়ার ৬ দিনের মাথায় স্কুলছাত্রীর মৃত্যু
রোগ শনাক্তে বিভ্রান্তি নাকি চিকিৎসায় ত্রুটি?
স্টাফ রিপোর্টার: কী এমন হলো, অসুস্থ হওয়ার সপ্তাহ ঘোরার আগেই মারা গেলো? চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী জেরিন তানিম অর্নার মৃত্যুতে সকলের মধ্যেই এ প্রশ্ন দানা বাঁধে। জেরিন তানিম অর্না শিক্ষক দম্পতি আব্দুস সালাম ও শামীমা আক্তার সীমার একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলো। গতকাল বাদ মাগরিব নিজ গ্রাম চুয়াডাঙ্গার তালতলা ঈদগা ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়।
অর্না অসুস্থ হওয়ার প্রথমে টনসিলের ব্যথার ওষুধ দেয়া হয়, তাতে সুস্থতার বদলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের মন্তব্য, অর্না আসলে চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলো। বিষয়টি বুঝতে না বুঝতেই বড্ড দেরি হয়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় নেয়ার প্রস্তুতিকালে বেলা সোয়া ১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালেই সকলকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। অর্নার পিতা আব্দুস সালাম চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের ঝিনুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি শিক্ষক সমিতির নেতাই শুধু নন, বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের চুয়াডাঙ্গার প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। মা শামীমা আক্তার সীমা হাসপাতাল সড়কের রিজিয়া খাতুন প্রভাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। চুয়াডাঙ্গা টিঅ্যান্ডটির বিপরীতে হকপাড়ায় বসবাস করেন। অল্প বয়সেই সদালপী শাদা মনের মানুষ হিসেবে আব্দুস সালাম দলমত নির্বিশেষে সবার মনেই ঠাঁই করে নিয়েছেন। তার মেয়ের মৃত্যুর খবরে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরে নেমে আসে মূলত শোকের ছায়া। হাসপাতালে উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
পরিবারের সদস্যসূত্রে জানা গেছে, জেরিন তানিম অর্না গত বুধবার গলায় ব্যথার কথা বলে। সাথে ছিলো জ্বর। চিকিৎসার জন্য প্রথমে নেয়া হয় আল ইমরান জুয়েলের নিকট। সুস্থতা না মেলার কারণে শুক্রবার নেয়া হয় ডা. সাইফুল্লাহ রাসেলের নিকট। অবস্থার উন্নতির বদলে দিন দিন অবনতির একপর্যায়ে গতপরশু বিকেলে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুজ্জামান খোকনের নিকট। তিনি হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। পরশু সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসকের সাথে কথা বলেই বাড়িতে নেয়া হয়। গতকাল ভোরে খিচুনিসহ শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার কথা বলতে শুরু করলে পুনরায় নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ চিকিৎসা দেয়ার পর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন হার্টে পানি। রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। চিকিসৎকেরা বলেন, অর্না মূলত ডেঙ্গজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। দ্রুত ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। রোগী কি অ্যাম্বুলেন্সে নিলে ঢাকায় পৌঁছুনো যাবে? প্রশ্ন উঠতেই স্কয়ারের এয়ার অ্যাম্বুুলেন্স নেয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয়। এছাড়া সাধারণ হেলিকপ্টারও নেয়ার জন্য প্রক্রিয়া করা হয়। স্কয়ার হাসপাতালের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলেও তা চুয়াডাঙ্গায় আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মেধাবী স্কুলছাত্রী অর্না। তার মৃত্যুতে শুধু ওর পিতা-মাতাই নয়, কেউই যেন খুঁজে পাচ্ছেন না সান্ত¦না। সকলের মুখেই একই প্রশ্ন, প্রথমে টনসিলের চিকিৎসা দেয়া হলো, এরপর দেয়া হলো জ্বরের ট্রিটমেন্ট। রোগী বাঁচানো গেলো না। এতেই কি চুয়াডাঙ্গার চিকিৎসা ব্যবস্থার নাজুক চিত্রের বিষয়টি স্পষ্ট নয়?
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল থেকে জেরিন তানিম অর্নার মৃতদেহ তালতলায় নেয়া হলে সেখানে স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরোপকারী আব্দুস সালামের কন্যা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে কেউই যেন বসে থাকেননি। সকলেই ছুটেছেন শেষবারের মতো একবার দেখতে এবং শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমাবেদনা জানাতে। বাদ আছর অর্নার মরদেহ শেষবারের মতো দেখাসহ শোকসন্তুপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে তালতলায় শোকার্ত বাড়িতে হাজির হন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খুস্তার জামিল, সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আলমগীর হান্নানসহ অনেকে। বাদ মাগরিব নামাজে জানাজায় মুসল্লির ঢল নামে। চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সাইফুল ইসলাম, সদর উপজেরা শিক্ষা আফিসার আবু হাসান, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিট কমান্ডার আবু হোসেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব সভাপতি আজাদ মালিতা, সাধারণ সম্পাদক ফাইজার চৌধুরী, সাংবাদিক এমএমএম আলাউদ্দীন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আব্দুল জব্বার সোনা, জেলা কৃষকদল সভাপতি অ্যাড. আ.স.ম আব্দুর রউফসহ দলমত নির্বিশেষে নামাজে জানাজায় শরিক হন। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, অন্যতম পরিচালক রিপনুল হাসান, দৈনিক মাথাভাঙ্গা সম্পাদক সরদার আল আমিন, বার্তা সম্পাদক আহাদ আলী মোল্লা, চ্যানেল আই প্রতিনিধি রাজিব হাসান কচি, এটিএন নিউজ প্রতিনিধি রফিক রহমান, এসএ টিভি প্রতিনিধি বিপুল আশরাফসহ বহু মানুষ উপস্থিত হয়ে শোকসন্তুপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন। নামাজে জানাজায় যারা শরিক হয়েছেন তাদের মধ্যে বহু বিশিষ্টজন থাকলেও সকলের নাম জানা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির চুয়াডাঙ্গা সভাপতি প্রবীণ শিক্ষক মাহতাব উদ্দীন শোকবার্তায় মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। শোকবার্তায় বলা হয়েছে, আব্দুস সালামের মতো একজন পরোপকারী মানুষের মেয়ের এভাবে মৃত্যু সত্যিই মেনে নেয়া যায় না। আগামী বৃহস্পতিবার বাদ আছর চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকা তালতলা গ্রামে নিজ বাড়িতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এ মাহফিলে সকলকে শরিক হওয়ার জন্য অর্নার পিতা-মাতা বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন।
কী এমন হলো যে, কয়েকদিনের মধ্যেই মারা গেলো কিশোরী অর্না? এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব না মিললেও ডেঙ্গু চিকনগুনিয়া কিংবা সোয়াইন ফ্লু নিয়েই আলোচনা চিকিৎসকদের অনেকের মধ্যে। তবে পশ্চিমবঙ্গের একাধিকসূত্রের বরাত দিয়ে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেছেন, রোগটার ধরন প্রথমে ডেঙ্গু, পরে চিকনগুনিয়া। শেষ পর্যন্ত হার্টে পানি জমে গেলে রোগী বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ধরনের সিমটম দেখা দিলে রোগীকে চিকিৎসকদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেয়াই উচিত। অবশ্য চিকিৎসকদের কেউ কেউ বলেছেন, বিষয়টি বুঝতে না বুঝতেই তো সর্বনাশ হয়ে গেলো।