শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও পিএসসিতে রিফাত পেয়েছে গোল্ডেন এ প্লাস সহযোগিতা পেলে একদিন ডাক্তার হয়ে শোধ করবে সমাজের ঋণ

আহাদ আলী মোল্লা: রিফাত রহমানের অদম্য ইচ্ছে শক্তি। তাইতো সে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডন জিপিএ-৫ পেয়েছে। যে পিতা-মাতা তাকে স্কুলে ভর্তি করার কথাই এক সময় ভাবতেন না, তারাও অবাক হয়েছেন রিফাতের এই ফলাফল দেখে। রিফাত প্রতিবন্ধী শিশুদের একজন। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বড় কোনো চিকিৎসকের দ্বারস্থও হতে পারেননি তার পিতা। রিফাতের পা থাকলেও জন্মের পর থেকে দু কদম হাঁটতে পারেনি সে। কিন্তু তার আগামীর জন্য পথচলা থেমে নেই। দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে। ডাক্তার হতে চায় সে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামের পিটিআই মোড়ের বাসিন্দা সাইদুর রহমান ও রহিমা খাতুনের ছোট ছেলে মো. রিফাত রহমান এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় নীলমণিগঞ্জ দীপশিখা প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এতে পিতা-মাতা যেমন খুশি, তেমনি তার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। তবে এ জন্য রিফাতকে চরম সাধনা করতে হয়েছে। যতোদিন ছাত্রজীবন থাকবে ততোদিন অব্যাহত থাকবে তার এ সাধনা।

চিকিৎসকদের ভাষায়, জন্মের সময় আঘাতজনিত কারণে রিফাতের পা দুটি স্বাভাবিক চলাচলের ক্ষমতা হারায়। প্রথমে না বোঝা গেলেও ১ বছর বয়সে তার পিতা-মাতা বুঝতে পারেন রিফাতের পায়ে সমস্যা আছে। অনেক চিকিৎসককে দেখানোও হয়। যতো বয়স হবে, সে ততো ভালোর দিকে যাবে বলে চিকিৎসকের মনে করলেও এখনো হাঁটতে পারে না সে। বাথরুমেও যেতে হয় অন্যের সহযোগিতায়। এ অবস্থায় পরিবারের সবাই ভেবেছিলো রিফাতকে পড়িয়ে আর কী হবে? কিন্তু তার অদম্য ইচ্ছেশক্তি তাকে স্কুল আঙিনায় নিয়ে যায়। বাবা সাইদুর রহমান একজন প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক। তিনি রিফাতের হাতে বই দিয়ে দেখেছেন পড়াশোনায় তার চরম আগ্রহ। এ আগ্রহই তাকে স্কুলে নিয়ে যায়। রিফাতের দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই; কিন্তু অন্যসব স্বাভাবিক শিশুকে টপকে তার ঈর্ষণীয় ফলাফল তাকে অনেক দূরে পৌঁছে দিয়েছে।

রিফাত খুব বন্ধুপ্রিয়। বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে তার খুব ভালো লাগে। অনেক বন্ধু তার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে স্কুলে নিয়ে যায়। অধিকাংশ দিন তার মা তাকে স্কুলে নিয়ে যান। কোনো কোনোদিন নিয়ে যান তার ছোট চাচা শামসুল হক।

রিফাতের মা রহিমা খাতুন জানান, স্কুলে প্রথম থেকেই তার রোল নম্বর ১। কিন্ডারগার্টেনের সব বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েও সে বৃত্তি পেয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও সে তার বন্ধুদের সাথে খেলেতে পারে না। কিন্তু বদ্ধ ঘরের ভেতরে শুয়ে-বসে চলছে তার লেখা-পড়ার সাধনা। এ বন্দিদশা জীবনে সে হতাশ না হয়ে, শপথ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জীবনে চিকিৎসক হবে বলে। যাতে আর কোনো শিশু এভাবে পঙ্গুত্ব জীবন বরণ না করে।

রিফাতের একমাত্র ভাই জুবায়ের রহমান রাফি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। পিতার অর্জিত অর্থের সিংহভাগ চলে যায় তার লেখাপড়ার খরচ বাবদ। সংসারের অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে ভালো কোনো চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়নি রিফাতকে। রিফাতের হুইল চেয়ারটাও নড়বড়ে হয়ে গেছে। ঠেললেও ঠিকমতো নড়তে চায় না। তার পিতার ইচ্ছে তেমন কোনো সহযোগিতা পেলে তাকে একবার ভারতের কোনো উন্নত চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। রিফাত তার এই ভালো ফলাফল অব্যাহত রাখতে চায়। সমাজের বিত্ত-বিভব হয়তো তাদের নেই; কিন্তু মানসিক শক্তিই তার পুঁজি। অবশ্য সমাজের কারো আর্থিক সহযোগিতায় তার চিকিৎসা ও লেখাপড়া চললে একদিন ডাক্তার হয়ে মানুষের চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে এ ঋণ পরিশোধ করতে চায় সে।