রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া

নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো

 

স্টাফ রিপোর্টার: ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে জালিয়াতপূর্ণ, দশম জাতীয় সংসদকে তামাশার এবং বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, জবরদস্তি ও ত্রাসের এ বেআইনি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ বেশিদিন নীরব থাকবে না। আমরাও চুপ থাকবো না। সময় বেঁধে দেবো না, তবে অতি দ্রুত নির্বাচন চাই। একটু গুছিয়ে নেয়ার পরেই আন্দোলনের কর্মসূচি দেবো।

এক মাসে ৩০০ বিরোধী নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুমের মাধ্যমে দেশকে পাইকারি হত্যাকাণ্ডের এক আতঙ্কিত জনপদে পরিণত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন এবং ১৯ দলীয় জোটনেতা বেগম খালেদা জিয়া। বলেছেন, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের তালিকা করে বেছে বেছে খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আটক করে গুলি চালিয়ে বা নির্মম দৈহিক নির্যাতনে পঙ্গু করে দেয়া এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। খুনি, সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিয়ে দেশের কারাগারগুলো ভরে ফেলা হয়েছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দিয়ে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও ক্ষমতাসীনদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে, চলছে অবাধ হত্যালীলা। আমি এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সকল মানবাধিকার সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে অব্যাহতভাবে বেড়ে চলা গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে গতকাল রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ উত্থাপন ও জাতিসংঘের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে বলে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি ভুল করেনি। সরকারই একতরফা নির্বাচন করে ভুল করেছে। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে প্রহসনের আয়োজন করা হয়েছিলো দেশবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা বর্জন করেছে। শতকরা ৫ জন ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যাননি। আওয়ামী রাজনীতির এতো বড় বিপর্যয় ও এমন শোচনীয় পরাজয় সাম্প্রতিককালে আর কখনও ঘটেনি। বাংলাদেশের অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিরোধীদের দমনে সরকারের চরম দমন-পীড়নের ব্যাপারে দেশি ও আন্তর্জাতিক নানা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তিনি সারাদেশে বিরোধী নেতাকর্মী হত্যা-গুম ও গ্রেফতারের চিত্র তুলে ধরেন। পাশাপাশি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার ও রাজনীতির নিষ্ঠুর দলনের পরিণতিতে চরমপন্থি ও জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। উগ্রবাদী পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে প্রতিবাদী তারুণ্য ও অবদমিত শক্তিকে। এ হঠকারিতার পরিণাম সম্পর্কে আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন ও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তিনি বলেন, আমরাও অনির্দিষ্টকাল ধরে শুধু সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানিয়েই যাবো, এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন কৌশল ও কর্মপন্থা নিরূপণ করেই বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে। সাংগঠনিকভাগে গুছিয়ে উঠে দ্রুতই আন্দোলন কর্মসূচি দেবে ১৯ দল।

হত্যা-গুম ও গ্রেফতারের পরিসংখ্যান: খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে এ পর্যন্ত খুন, গুম, নির্যাতন ও গ্রেফতারের যে হিসাব, তালিকা ও নাম-ঠিকানা এসেছে তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছি। এ হিসাব গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র এক মাসের। প্রাপ্ত এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সময়ে সারাদেশে প্রায় ৩০০ রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন ও গুম হয়েছেন। তিনি বলেন, যৌথবাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে ঠাকুরগাঁওয়ে যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে বিএনপি ও ছাত্রদলের ৪ জন ও দিনাজপুরে ৫ জন নিহত হয়েছেন। নীলফামারীতে বিএনপি ও অঙ্গদলের স্থানীয় ৬ জন নিহত ও ৯ জন গুম হয়েছেন। লালমনিরহাটে বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪ জনসহ ৬ জন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। গাইবান্ধায় নিহত ৬ জনের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় নেতাকর্মী। গাইবান্ধায় গুম হয়েছেন স্থানীয় বিএনপির ২ নেতাসহ ১১ জন, ঝিনাইদহে ২ জন ও খুলনায় ১ জন গুম হয়েছেন। জয়পুরহাটে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও যৌথবাহিনীর গুলিতে ১২ জন ও বগুড়ায় যুবদলের ৩ নেতাকর্মীসহ নিহত হয়েছেন ৫ জন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় বিএনপির ৭ নেতাকর্মীসহ ১৯ দলীয় জোটের ১৩ জন নিহত হয়েছেন। যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৭ বিএনপি নেতাকর্মীসহ সিরাজগঞ্জে ১৪ জন, পাবনায় ৭ জন নিহত হয়েছেন। মেহেরপুরে যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে জামায়াতের জেলা আমির তারেক মোহাম্মদ সাইফুল হকসহ বিএনপি ও জোটের ৭ জন নিহত হয়েছেন। যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে যশোরে ছাত্রদলের জেলা সহসভাপতি কবির হোসেন পলাশসহ ৪ জন। খুলনা জেলায় বিএনপি ও ছাত্রদলের স্থানীয় পর্যায়ের ৪ জন নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সাতক্ষীরায় বিএনপি ও যুবদলের ৫ নেতাসহ ২৭ জন যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। গুম করা হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের তিন বিএনপি নেতাসহ ৬ জনকে। যারা নিহত ও গুম হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় নেতাকর্মী। ঢাকা মহানগরীতে এই এক মাসে কেবল বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জন নেতাকে বিভিন্ন স্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলেছে। সিলেটে গুম হয়েছে ছাত্রদল নেতাকর্মীসহ ৩ জন। কুষ্টিয়ায় জেলা বিএনপির ৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিহত হয়েছেন। কুমিল্লায় বিএনপি ও অঙ্গদলের ৪ জন নিহত হয়েছে। গুম হয়েছে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন পারভেজ। চাঁদপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন ২৩ জন। এরমধ্যে ২১ জনই জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মী। ফেনীতে বিএনপি ও অঙ্গদলের ৫ নেতাকর্মীসহ ৯ জন নিহত হয়েছেন যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে। নোয়াখালীতে বিএনপি ও ছাত্রদল নেতাসহ ১৯ দলের ১১ জন নিহত হয়েছেন। লক্ষ্মীপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ তাণ্ডবে ২০ জন নিহত হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতা। গুম করা হয়েছে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ জুয়েলসহ ২ জনকে। চট্টগ্রামে বিএনপি ও জোটের ১৫ জন যৌথবাহিনীর গুলি ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন। গুম করা হয়েছে ৩ জনকে। বিএনপি ও অঙ্গদলের ১৭ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে কক্সবাজারে। এছাড়া, যৌথবাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে রংপুরে ২ জন, কুড়িগ্রামে ২ জন, রাজশাহীতে পৌর ছাত্রদলের যুগ্মসম্পাদকসহ ২ জন, নাটোরে ২ জন, নওগাঁয় ২ জন, চুয়াডাঙ্গায় ২ জন, মাগুরা ও বাগেরহাটে ২ জন, পটুয়াখালীতে ১ জন ও পিরোজপুরে ১ জন, কিশোরগঞ্জে ১ জন, মুন্সিগঞ্জে ১ ও ঝিনাইদহে ১ জন নিহত হয়েছেন।

খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মাত্র এক মাসেই বিরোধীদলের ২৪২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা ও ৬০ জনকে গুম করা হয়েছে। সাম্প্রতিক দুটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে বিনা বিচারে হত্যা ও গুম একটি সভ্য সমাজে চলতে পারে না। গত ২৮ জানুয়ারি বিকেলে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বিএনপির যুগ্মআহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। তাকে ৱ্যাবের হাতে দেয়া হয়। ৱ্যাব তাকে পল্টন থানায় হস্তান্তর করে। বিএনপির অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন রাতে থানায় গিয়ে তৌহিদের উপস্থিতিতে পুলিশের সাথে কথা বলেন। পরদিন তৌহিদকে পুলিশ পাহারায় তাদের গাড়িতে করে নোয়াখালী নিয়ে যাওয়া হয়। খোকন পুলিশ ও ৱ্যাবের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে তৌহিদকে আদালতে সোপর্দ করার অনুরোধ করেন। তা সত্ত্বেও তৌহিদকে গুলি করে হত্যা করে হাসপাতালে লাশ রেখে যায়। খালেদা জিয়া বলেন, নীলফামারীর একজন এমপির গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত বিএনপির তিন স্থানীয় নেতাকে যৌথবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিরোধী দল আন্দোলন শুরুর পর থেকে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিরোধী দলের ২৭৬ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। আটকের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ জনকে। এ সময় তিনি দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসাক) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০১৩ প্রতিবেদন, দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এক বিবৃতি, দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) বিবৃতি, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন, দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত আসক’র প্রতিবেদন ও পুলিশের হিসাব, দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশিত নানা তথ্য তুলে ধরেন।
দুর্বলের প্রতিশোধ ভয়ঙ্কর: বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আপনারা জানেন দুর্বলের প্রতিশোধ ভয়ঙ্কর। পরাজয়ের গ্লানি ভয়াবহ। অক্ষমতার জিঘাংসা মারাত্মক। সম্পূর্ণ গণবিচ্ছিন্ন ও জনগণ কর্তৃক বর্জিত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা একদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে, অপরদিকে দলীয় সন্ত্রাসীদের সারাদেশে লেলিয়ে দিয়েছে জনগণ ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার এমন নিষ্ঠুর তাণ্ডব ও ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলের পৈশাচিক বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।