রাজধানীতে আজ থেকে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ

পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত মিছিল সমাবেশ মানববন্ধন গণঅবস্থান নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ

স্টাফ রিপোর্টার: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাজধানীতে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পুলিশ। নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকার গঠনে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব দেয়ার পরদিন ঢাকা মহানগর পুলিশ এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিষেধাজ্ঞা জারির নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সমালোচনা করেছেন বিশিষ্টজনেরাও। এ সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে জানিয়েছেন তারা। নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে আজ সারাদেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ১৮ দল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তবে এতে কোনো কাজ হবে না।

২৫ অক্টোবর ঢাকা সমাবেশ করতে মহানগর পুলিশের কাছে আবেদন করেছে বিএনপি। বিরোধীদলের এ সমাবেশ ঘোষণার পরই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘোষণার মধ্যেই গতকাল ডিএমপির পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞার জারির পর মহানগর আওয়ামী লীগ তাদের সমাবেশ স্থগিত করে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশ দেন।

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ডিএমপির অধ্যাদেশ অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি আরও বলেন, আগামী ২৫ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাল্টাপাল্টি সভা সমাবেশ আহ্বান করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ ১২টি দল ও সংগঠন ২৫ অক্টোবরসহ আগের কয়েকদিনে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপি কমিশনারের কাছে আবেদন করেছিলো।

এদিকে আজ রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পেশাজীবী সংগঠনের এক সমাবেশে খালেদা জিয়ার যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। এ সমাবেশ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে বলে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ থেকে পরস্পরবিরোধী কয়েকটি দলের ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সভা-সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে। সমাবেশকে সামনে রেখে বিভিন্ন গোষ্ঠী ক্রমাগত প্রকাশ্যে মারাত্মক উসকানিমূলক ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন বক্তব্য প্রদান করে আসছেন। ফলে জনমনে অনিশ্চয়তা, ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টির প্রকৃত আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসব মিছিল, সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বিরাজমান।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, যেহেতু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তাই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্সের ২৮ ও ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে ২০ অক্টোবর রোববার সকাল ৬ টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সকল প্রকার মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণ-অবস্থান, সভা-সমাবেশ, মিছিল, সকল প্রকার ছড়ি বা লাঠি, বিস্ফোরক দ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।

এছাড়াও বিজ্ঞপ্তিতে যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে/বসে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল করা যাবে না বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

ডিএমপি সূত্র জানায়, রাজধানীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়ে গতকাল ডিএমপি সদর দফতরে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডিএমপি কমিশনারের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তারা, বিভাগীয় উপপুলিশ কমিশনার ও সকল থানার ওসি। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে কোনোভাবেই অবনতি না হয় সে ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার সবাইকে সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।

অন্যান্য দলের নিন্দা: সভা, সমাবেশের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা জারির নিন্দা করে বক্তব্য দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। গতকাল সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে সিপিবি ও বাসদ নেতৃবৃন্দ বলেন, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে  সরকার  জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। সঙ্কট অনিশ্চয়তা থেকে দেশকে রক্ষা না করে সরকার উল্টো পথে হাঁটছে। এতে দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট আরও জটিল হবে। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন খালেকুজ্জামান, সৈয়দ আবু জাফর, হায়দার আকবর খান রনো, শামসুজ্জমান সেলিম প্রমুখ।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি  আ.স.ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এক বিবৃতিতে বলেন, সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং ও মানববন্ধনের ওপর বিধিনিষেধ জারি সরকারের স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি ও জনভীতির বহিঃপ্রকাশ। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার এক সভায় বলা হয়, এ স্বৈরাতান্তিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে এ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বাম মোর্চার সমন্বয়ক ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক সাইফুল হকের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন সিদ্দিকুর রহমান, মোশরেফা মিশু, জোনায়েদ সাকি, ফখরুদ্দীন আতিক, শামীম ইমাম, হামিদুল হক প্রমুখ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় একজন নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়া ও আলোচনার আহ্বান জানানোর পর রাজপথে আন্দোলনের প্রয়োজন পড়ে না। দু-একদিনের মধ্যেই বিরোধী দলকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তার বিএনপিদলীয় প্রতিপক্ষকে চিঠি দেবেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ একজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে গতকাল শনিবারও সৈয়দ আশরাফের টেলিফোনে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের আলোকে আলোচনায় বসার কথা বলা হয়। তৃতীয় কোনো পক্ষ, কোনো স্বার্থান্বেষী কুচক্রীমহল ২৫ অক্টোবর বোমা বিস্ফোরণ, গোলযোগ বাঁধিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের কাছে এ ধরনের তথ্য থাকার কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সরকারি দলের এ ধরনের বক্তব্য বিরোধীদলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা মনে করেন, বিএনপিবিহীন একতরফা নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। সংসদ বিলুপ্ত করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, শেখ হাসিনা ছাড়া নিরপেক্ষ, নির্দলীয় অবস্থানে থাকা একজনের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা, বিরোধীদলের প্রতিনিধিত্বের হার প্রভৃতিসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার করা হয়নি বা উল্লেখই নেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।

সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেন, কিছু বিষয় আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পন্ন করা যাবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থাকার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অনড় থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে তার প্রাপ্য প্রতিনিধিত্বের বেশি সদস্য মন্ত্রিসভায় নেয়ার ব্যাপারে সরকারের মনোভাব নমনীয়। এমনকি স্বরাষ্ট্র, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও বিরোধী দলের হাতে ছেড়ে দিতে অসম্মত হবে না সরকার। তফসিল ঘোষণার পর গুরুত্বপূর্ণ এসব মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না-ও আসে এসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে ছেড়ে দেয়া হতে পারে। সরকারি মহল মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে অস্পষ্টতা কিছু থাকলেও সরকারের তরফ থেকে একটা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এখন পাল্টা প্রস্তাব দেয়ার দায়িত্ব বিরোধীদলের। বিরোধীদল থেকে প্রস্তাব না এলে, সংলাপ না হলেও প্রধানমন্ত্রী ২৪ অক্টোবর প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করে তার পরামর্শ নেবেন। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। তফসিল ঘোষণার পরপরই গঠন করা হবে ছোট আকারের অন্তর্বর্তী সরকার।