রমজানের আগেই বাজার অস্থির

স্টাফ রিপোর্টার: রমজানে কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে_ ফি বছর সরকারের এমন হুমকি-ধামকির মুখে ব্যবসায়ীরা এবার নতুন ফন্দিতে রোজার বেশ আগেই ধাপে ধাপে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর উপর সম্প্রতি অকাল বন্যা ও টানা বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলাদির ক্ষতি হওয়ায় এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় নিত্যপণ্য দামের পাগলাঘোড়া এখন বেপরোয়া হয়ে ছুটছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম এমনভাবে বাড়ানো হচ্ছে যে রমজানে তা আর বাড়ানোর কোনো প্রয়োজনই পড়বে না। বরং সরকারের বাজার মনিটরিং কমিটির চাপে রমজানে অধিক ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের দাম কিছুটা কমানো হলেও ব্যবসায়ীদের উচ্চ মুনাফা থাকবে। এতে বাজার সিন্ডিকেটের দু’কুলই রক্ষা হবে।

বাজার বিশ্লেষকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণে প্রশাসনিক দুর্বলতা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারা, নিত্যপণ্যের দর তদারকিতে গাফিলতি এবং বিশেষ মহলের অপকৌশলে বছরের পর বছর ধরে টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) নিষ্কিয় হয়ে থাকায় রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার বরাবরই ব্যর্থ। এর উপর মন্ত্রী-আমলাদের আত্মতুষ্টি, দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। নিত্যপণ্যের পাগলাঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে হলে শুধু রমজানেই নয়, সারাবছর বাজার তদারকি জরুরি বলে মন্তব্য করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।

এদিকে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বাজার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে এর ব্যর্থতা ঢাকতেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সবচেয়ে বেশি তৎপর। এ কারণে রোজার আগেই নিত্যপণ্যের দর হু হু করে বাড়লেও তাতে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং রমজানে নতুন করে জিনিসপত্রের দাম আর বেশি বাড়বে না তা ভেবেই আত্মতুষ্টিতে ভুগছে সরকার। বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী মহলের অাঁতাত থাকারও অভিযোগ তুলেছে ভোক্তা অধিকারের একাধিক সংগঠন। যদিও এরই মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘শুধু রমজানে নয়, সারা বছরই দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে, দাম বাড়বে না। গত রমজানের আগে ব্যবসায়ীরা অঙ্গীকার করেছিলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না, তারা সেই কথা রেখেছেন। এবারো তারা সেই ব্যবস্থাই নেবেন বলেও আশাবাদী মন্ত্রী। তবে গত কয়েকদিনে রাজধানীর একাধিক পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের তেমন কোনো মিল নেই। গত কয়েকদিনে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। ধাপে ধাপে বাড়ছে রসুন, আদার দামও। এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, শুকনো মরিচ, হলুদ, জিরা, তেজপাতার দরও অনেকটা পাল্লা দিয়ে ছুটছে। বিশেষ করে খুচরা বাজারে বিভিন্ন মসলার দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে।

এলপ্পি গ্রিন এলাচ পাইকারি বাজারে দেড় হাজার টাকা দরে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৪শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মাস আগেও এই এলাচ হাজার বারোশ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গুয়াতেমালার এলাচ প্রতিকেজি এক হাজার থেকে লাফিয়ে ১ হাজার ৩শ’ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকায় এসে ঠেকেছে। লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি দেড় থেকে দু’হাজার টাকা কেজি দরে। যা সপ্তাহ দু’য়েক আগেও এক হাজার একশ’ থেকে এক হাজার দু’শ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে।

এদিকে বর্তমান বাজারে দারচিনি মানভেদে প্রতিকেজি পৌনে তিনশ’ থেকে তিনশ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ক’দিন আগেও ছিল মাত্র আড়াইশ’ টাকা। ভারতীয় গোল মরিচের দামও কেজিপ্রতি দেড় থেকে দুইশ’ টাকা বেড়েছে। গত দু’সপ্তায় বিভিন্ন মানের জিরার দামও ধাপে ধাপে চড়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা রসুন বর্তমানে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা আর দেশি রসুন একশ’ টাকা থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাসের ব্যবধানে রসুনের দাম কেজিতে প্রায় ৪০ টাকা বেড়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন ধরনের মসলার দাম আগের বছরের তুলনায় এবার সর্বনিম্ন ২৫ থেকে ঊধর্ে্ব প্রায় দেড়শ’ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে। যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তবে মসলার বাজার দর দফায় দফায় বাড়ায় তা অনেকেরই নজরে পড়েনি বলে দাবি করেন তারা।
এদিকে গত কয়েকদিনে ছোলা, ডাল, খেজুর, চিনি, মুড়ির দাম তেমন না বাড়লেও দু’তিন মাস আগে থেকেই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ তুলেছেন। তারা জানান, প্রশাসনের নজর এড়াতে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা রমজানে অধিক ব্যবহৃত ভোগ্যপণ্যের তালিকায় থাকা ছোলা, চিনি, গম, তেল ইত্যাদি পণ্যের দাম বিভিন্ন অজুহাতে আগেভাগেই বাড়িয়ে নিয়েছেন। এ সময় তারা দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বলেছেন, আমদানি কম হওয়ার কারণে রমজানের আগেই দাম বাড়ছে। তবে বাজার পর্যবেক্ষকদের তথ্য, ওই সময় বেশি আমদানি করে ব্যবসায়ীরা মজুদ করেছে। পরে ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়েছে। মাস দু’য়েক আগে খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ ভালো মানের অস্ট্রেলিয়ার ছোলা দু’হাজার সাতশ’ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময় সর্বোচ্চ দু’হাজার চারশ’ টাকায় পাওয়া গেছে। মাঝারি মানের প্রতিমণ অস্ট্রেলিয়ার ছোলা মার্চ মাসে দু’হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল সর্বোচ্চ দু’হাজার চারশ’ টাকা। অথচ জানুয়ারিতে ২৭ হাজার টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। এছাড়াও বছরের অন্যান্য সময় ব্যবসায়িরা গড়ে ১০ হাজার টন আমদানি করেছেন। এছাড়া চিনি ও ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেও একই কৌশলে আগেই দামি বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে।

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেন, এক সময় রমজান মাসের কয়েকদিন আগে থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্যের মজুদ ও দাম বাড়াত। তবে গত কয়েক বছর ধরে রমজানের আগে বাজার মনিটরিং কমিটি হঠাৎ ‘করিৎকর্মা’ হয়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা তাদের ছক পাল্টেছে। তারা রমজানের দু-তিন মাস আগেই পণ্যের মজুদ ও দাম বাড়িয়ে রাখে। এক-দেড় মাস ধরে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ও মজুদ শুরু হয়ে তা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন আমদানিকারক থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী পর্যায়ে বেচাকেনা চলছে।  এদিকে ডলারের দর বাড়লেও রমজানের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা যে আশ্বাস দিয়েছেন তা কতটা ধোপে টিকবে ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্যে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, ‘রমজানে জিনিসপত্রের দাম না বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কিন্তু লোকসান দিয়ে মাল বিক্রি করব তা তো বলিনি। ডলারের দাম বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে কেউ কেউ অযথাই পানি ঘোলা করছে।’ ডলারের দাম সম্প্রতি বাড়লেও রমজানের পণ্যের মজুদ তো বেশ আগেই করা হয়েছে, তাহলে তার দাম বাড়বে কেন- এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ী ওই নেতা কোনো সদুত্তোর দিতে পারেননি।