যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ছেড়ে সমঝোতায় আসুন

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতকে ছেড়ে সমঝোতায় আসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর গতকাল সোমবার বিকেলে গণভবনের খোলা চত্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহবান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি গণতন্ত্র ও জাতির শান্তি এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিরোধীদলকে সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার করে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছি। আমি বিরোধীদলের সম্মানিত নেত্রীসহ সবাইকে আবারও আহ্বান জানাই, সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার করে যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় আসুন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেই সমাধান করা হবে। সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে এবং সব ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। বিরোধীদলের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত এবং সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যা, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের অপপ্রয়াস প্রত্যাখ্যান করে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে মন্তব্য করে সরকার, দল, জোট ও জনগণের পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। সেইসাথে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘আমি সুস্পষ্ট করে ঘোষণা করছি আমার নির্বাচিত সরকারের প্রথম কাজ হবে যেকোনো মূল্যে দেশের জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করা। আমি তাই নির্বাচনোত্তর যে কোনো সন্ত্রাস ও সহিংসতা কঠোর হাতে দমন করার জন্য প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছি।’ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের হলফনামায় অস্বাভাবিক আয়ের উল্লেখ রয়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেউ যদি দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি কোনো দুর্নীতিবাজকে প্রটেকশন দেব না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনের স্থল গণভবনের খোলা চত্বরে আসেন বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে। এর কিছুক্ষণ আগে গণভবনের একটি সম্মেলন কক্ষে বিদেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে গণভবনের খোলা চত্বরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিখিত বক্তৃতার পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা, নবনির্বাচিত এবং নবম জাতীয় সংসদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিলো খুবই কম, এ নির্বাচনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিরোধী দলের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছিলো যাতে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে না আসেন। তারপরও জনগণ বোমাবাজি ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্রে এসেছে। জনগণ ভোট দিতে পেরেছে। আমি তাতেই সন্তুষ্ট।’ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে- একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এ নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ উঠতে পারে- এটা আমি বিশ্বাস করি না। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে তারা ভোট বর্জন করেছে। যারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি তাদের জন্য কারা কাঁদবে তিনি জানেন না। কোনো কোনো ভোট কেন্দ্রে ভোটাররা যেতে পারেননি- সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে কেন পারল না?

যারা সন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করল তাদের শাস্তি হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার অবশ্যই ভোটারদের নিরাপত্তা দিয়েছে। আর যারা মানুষ হত্যা করেছে, অবশ্যই আইনসম্মতভাবে তাদের বিচার হবে। যারা জনগণের জানমাল নিয়ে খেলবে তাদের তারা ছাড়বেন না।

নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি, এ ইস্যুতে বিরোধীদল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা করবে-এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সরকার কী উদ্যোগ নেবে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না তারা এমনটা চায়। এ ব্যাপারে সরকার তার নিজস্ব উপায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে কি-না জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন বিচারাধীন রয়েছে। তাই এ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। নির্বাচন নিয়ে কোনো চাপ এলে তিনি তার অবস্থান থেকে সরে আসবেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা পাল্টা জানতে চান- এমন কোনো চাপ এসেছিল কি যেখান থেকে তিনি সরে এসেছেন?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ নির্বাচনে জনগণ সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নাশকতার বিরুদ্ধে শান্তি, সাংবিধানিক ধারা এবং গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এ নির্বাচনে বিজয় হয়েছে গণতন্ত্রের এবং পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির। শেখ হাসিনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, প্রধান বিরোধীদলসহ সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন আরও প্রতিযোগিতামূলক ও ইতিবাচক হতে পারত। আমাদের সবার প্রত্যাশা ছিলো প্রধান বিরোধীদল বিএনপি গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে এবং সাংবিধানিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এ লক্ষ্যে তিনি বিরোধী দলের নেত্রীসহ সবাইকে বারবার সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু তারা তার এ উদ্যোগ ও অনুরোধে সাড়া না দিয়ে বেছে নিয়েছে সন্ত্রাস, সহিংসতা, নৈরাজ্য, নাশকতা ও ধ্বংসের পথ। দেশকে অরাজকতা ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তাদের সন্ত্রাস ও নাশকতায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে দেশের নিরীহ নাগরিক, ধ্বংস হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি এবং ব্যাহত হচ্ছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষ শান্তি চায়, উন্নয়ন চায় এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়। নিরীহ নাগরিকের রক্তে আজ গণতন্ত্র রক্তাক্ত, সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির শিকার বার্ন ইউনিটের অগ্নিদগ্ধ মানুষের আর্তনাদ জাতির বিবেককে আজ দংশন করছে। জাতি আজ এর অবসান চায়। তিনি জানান, নির্বাচনবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের অগ্নিসংযোগে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা অতিসত্বর মেরামত করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানার উৎপাদন এবং রফতানি বাণিজ্যকে সব রাজনৈতিক সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। নাগরিকদের স্বাভাবিক জনজীবন সুনিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হবে। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস এবং নাশকতার শিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার হতাহত সদস্যদের পরিবারকে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। আহতদের চিকিৎসাসেবা চলছে, সেটা অব্যাহত রাখা হবে। সাধারণ মানুষ যারা সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকেও সহায়তা করা হবে। যারা আহত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে। তিনি হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার কাজ অব্যাহত থাকবে এবং বিচারের রায় কার্যকর করা হবে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।