যক্ষ্মার জীবাণু এমডিআর শরীরে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শিপন

 

আরেফিন আমীন:শিপন সব কিছু জেনেও শরীরে এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স) বা ওষুধ প্রতিরোধক যক্ষ্মার জীবাণু বয়ে বেড়াচ্ছেন। ছেলে মেয়ের মুখে দু বেলা দু মুঠো ভাত তুলে দেয়ার জন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। অথচ তার পিছু ধাওয়া করছে জমদূত মৃত্যু।

কী এমন রোগ যে, নিরুপায় শিপন? এ রোগটি এইডস রোগের মতোই সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমন ভয়ঙ্কর রোগ জানা সত্ত্বেও চিকিৎসা না নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শিপন। শিপন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাসনহাটি গ্রামের বৃদ্ধ আয়াত আলীর ছেলে। আয়াত আলী একজন হাঁপানী রোগী হলেও বৃদ্ধ মা হালিমা খাতুন, স্ত্রী রেকসোনা, ছেলে জুয়েল (৬) ও মেয়ে লামিয়া (১) নিয়ে তার সংসার। উপার্জনক্ষম একমাত্র শিপনকে নিয়ে সংসারের সদস্যরা আশায় বুক বাঁধলেও তা সিঁকে উঠতে পারে এমনই মন্তব্য চিকিৎসকদের। এ চিকিৎসা পরীক্ষার জন্য চুয়াডাঙ্গা যক্ষ্মা ক্লিনিকে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ছুটতে হচ্ছে বিভাগীয় এবং রাজধানী শহরে। শিপন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় এমডিআর চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদীর কারণে সংসারের সুখের কথা চিন্তা করে এ চিকিৎসার প্রতি তার বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে ১৫ কি.মি. দূরে সদর উপজেলার নিভৃত পল্লি হাসনহাটি গ্রাম। গ্রামের একটি মাটির দেয়াল দেয়া টালির চালার এক কামরার ঘরে শিপন তার ৬ সদস্যদের নিয়ে বসবাস করেন। পেশায় তিনি দিনমজুর। ২০১০ সালে তার জ্বর ও কাশি হয়। পল্লি চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হলে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে কফ পরীক্ষা করা হয়। ধরা পরে যক্ষ্মা জীবাণু।এসময় তাকে ব্র্যাকের ডটস (ডাইরেক্টলি অবজারভড ট্রিটমেন্ট সর্ট কোর্স) চিকিৎসা শুরু করা হয়। কিছুদিন ওষুধ সেবনের পরে শিপন তা বন্ধ করে দেন। পরে ব্র্যাকের কর্মীদের আন্তরিকতার কারণে সে ৮ মাসের কোর্স সম্পন্ন করে সুস্থ হয়। পরবতীর্তে ২০১৪ সালে পুনরায় তার কফ পরীক্ষায় যক্ষ্মা জীবাণু ধরা পরে। এসময় তাকে এমডিআর পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দেন চিকিৎসক। চুয়াডাঙ্গায় এমডিআর পরীক্ষা না থাকায় তাকে কুষ্টিয়া বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে পাঠানো হয়। সেখানে তার এমডিআর ধরা পড়ে। এরপর ব্র্যাকের উদ্যোগে চিকিৎসার জন্য তাকে খুলনা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দু দিন চিকিৎসা নিয়ে সে পালিয়ে চলে আসে। কারণ তার পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। পুনরায় গত ১ মাস আগে তাকে আবারও খুলনায় ভর্তি করা হলে সে কাউকে কিছু না বলে চলে আসে। ব্র্যাকের কর্মীরা তার খোঁজ নিতে গেলে বাড়ি থেকে বলা হয় সে বাড়ি নেই।এভাবেই চলছিলো প্রায় ২ মাস। ৬জুন বিকেলে শিপনের সাথে কথা হয় তার বাড়িতে। সে বলেন চিকিৎসা নিতেই খুলনা গিয়েছিলাম। ভর্তির ৩-৪ দিন পর রক্ত পরীক্ষার জন্য খুলনা ২৫০ বেড হাসপাতালে যেতে বলে। এ পরীক্ষার জন্য ১হাজার ২০০ টাকা দাবি করে। টাকা যোগাড় না করতে পেরে চলে আসি। শিপনের স্ত্রী রেকসোনা জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম যদি ৩ মাসের জন্য চিকিৎসায় ভর্তি হয়, সংসার চালাবে কে?এটা ভেবেই সে চলে আসে। মা হলিমা খাতুন জানান, যদি কোনো সহোদয় ব্যক্তি বা সংস্থা তার সংসারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতো, তাহলে ছেলেকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করা সম্ভব হতো।

সংশিষ্ট সূত্রে জনা যায়, ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার ১৬ জন রোগীকে এমডিআর পরীক্ষার জন্য কুষ্টিয়া বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে পাঠানো হয়। এর মধ্যে শিপনের এমডিআর রোগ ধরা পড়ে। এর আগে ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর ধরা পড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার সাহেবপুর গ্রামের রাহাত উল্লাহর ছেলে নজরুল ইসলাম। তিনি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। তারপর ২০১১ সালের ১ অক্টোবর ধরা পড়ে একই উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের নুরুল হকের স্ত্রী ফাজিলা বেগমের। তিনিও চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনযাপন করছেন। ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর ধরা পড়ে দামুড়হুদা উপজেলার আজিমপুর গ্রামের মৃত সোবান আলীর ছেলে রবিউলের। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৩ সালের ৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

চুয়াডাঙ্গা বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের জুনিয়ার কনসালটেন্ট ডা. রতন কুমার সিংহ জানান, এমডিআর এমন একটি রোগ যার সঠিক চিকিৎসা না নিলে মৃত্যু অবধারিত। এটি এইডস রোগীর মতোই সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই এ রোগীদের চিকিৎসায় সমাজের দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।