মোহাম্মদপুরে বস্তির শত ঘর ভস্মীভূত : শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বস্তিতে আগুন লেগে দগ্ধ হয়ে তিন বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আগুনে ওই বস্তির শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। গতকাল রোববার বেলা পৌনে ১টার দিকে কাটাসুরের পুলপাড়ের ওই বস্তিতে পুড়ে যাওয়া ঘরের ধ্বংসস্তূপ থেকে ফাতেমা (৩) নামে ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক জহিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আগুন লাগার পর সোয়া এক ঘণ্টার মাথায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততোক্ষণে পুড়ে মারা যায় শিশুটি।

তবে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। তবে ওই বস্তি সংলগ্ন একটি বাড়ির বাসিন্দা ডেসার সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান জানান, সকালে আগুন আগুন চিত্কার শুনে তিনি বাইরে এসে ধোঁয়া দেখতে পান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বস্তির কোনো ঘরের চুলা থেকে আগুন লাগতে পারে বলে তিনিসহ এলাকাবাসীর ধারণা।

মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জানান, ওই বস্তির ঘরগুলোতে ৫৫১টি পরিবার বাস করতো। অধিকাংশই সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইকরামুল হক ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ কেজি চাল ও একটি করে কম্বল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

জানা গেছে, এই বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দাই নিম্নবিত্ত। আগুন নেভার পরও দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে বস্তি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা যায়। সেই স্তূপের নিচ থেকেই কেউ ট্রাঙ্ক, কেউ আলমারি টেনে বের করছেন। কেউ বা পুড়ে যাওয়া সেলাইমেশিন, থালা, বাটি যদি কিছু পাওয়া যায় তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এখানে বসবাসকারীরা কেউ বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন, কেউ পোশাক কারখানার শ্রমিক, কেউ বা পিঠা বিক্রেতা। তবে সকালে বেশির ভাগ লোক কাজের উদ্দেশে বাইরে চলে যাওয়ায় কম হতাহত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) এ.কে.এম শাকিল নেওয়াজ দাবি করেন, আগুন লাগার কারণ এবং এ পর্যন্ত কতো ক্ষতি হলো, তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে। পুড়ে যাওয়া একটি বস্তু পাওয়া গেছে। সেটিই বাচ্চার লাশ কি-না যাচাই করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৫০০ পরিবার এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এলাকায় দেখা গেলো, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন। দলটির ওয়ার্ড সেক্রেটারি আজিজুল ইসলাম বললেন, ঘটনার পরপর স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক দেখতে এসেছিলেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে বলেছেন। এরপর তিনি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন।

স্বপ্ন পুড়ে ছাই: এ বস্তিতে একেকজনের অধীনে ২৫ থেকে ৩০টি ঘর ছিলো। তাদেরই একজন কুলসুম আক্তার জানান, তার ঘরসহ প্রায় শতাধিক ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। তিনিও মেয়েকে মাদরাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে কেউ ছিলো না। তবে এক ঘরের সংসারে আলমারি, ফ্রিজসহ জিনিস যা ছিলো তার সবই শেষ। কুলসুম এবং সেখানে বসবাসকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ইট, বাঁশ এবং টিন দিয়ে বানানো স্থাপনাগুলো দোতলা এমনকি তিনতলা পর্যন্ত করা হয়েছিলো। একেক ঘরের ভাড়া ছিলো আড়াই হাজার টাকা বা তার বেশি। অনেকে সেখানেই মুদির দোকান দিয়েছিলেন। তাদের অনেকে ঘর এবং দোকান দুটোই হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

পেশায় টাইলস মিস্ত্রি ফয়সাল বসে বিলাপ করছিলেন। তিনি বলেন, ঘরে ১২ হাজারের বেশি টাকা ছিলো। সকালে কাজে গেছিলাম। তারপর আইস্যা দেখি শেষ। চিন্তা করতাছি খাবো কী, থাকবো কই। পোশাক শ্রমিক নাজমা পুড়ে যাওয়া ট্রাঙ্ক থেকে অনেক কষ্টে জমানো ৪০ হাজার টাকা খুঁজছিলেন। যখন পেলেন, তখন আর সেই টাকার কোনো দাম নেই। ৫০০ টাকা নোটগুলো আবছা দেখা গেলো শুধু। একজন জানালেন, বের হওয়ার সময় ছোট শাদাকালো টেলিভিশনটা তিনি শুধু বের করতে পেরেছিলেন। কিশোরী চায়না বলছিলো, আগের দিনই পোশাক কারখানা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন পেয়েছিলো। আগুন লাগার খবর শুনে শুধু নিজের জানটুকু নিয়ে বের হয়েছে। মুদির দোকানের মালিক আবুল কালাম পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এলাকায় তার দোকানই একটু বড় ছিলো। তিনি জানালেন, দোকানের লাখ লাখ টাকার জিনিস পুড়ে গেছে। দোকানে ৫০ হাজার টাকাও ছিলো। শুধু দোকান নয়, তার ঘরও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।