মোবাইলফোনের লোভের বলি হলো এসএসসি পরীক্ষার্থী আল আমিন

মাজেদুল হক মানিক: মাত্র আট হাজার টাকার একটি মোবাইলফোনের লোভের বলি হলো এসএসসি পরীক্ষার্থী আল আমিন। আল আমিনকে সরল বিশ্বাসে ধোকা দিয়ে খাওয়ানো হয় প্রাণনাশকারী তরল পদার্থ। সম্পর্কে চাচা সাগর হোসেনের অনুরোধে আল আমিন কোমল পানীয় ভেবে পান করে ওই তরল পদার্থ। এর পরেই সাগরের চোখের সামনে তরতাজা তরুণ মৃত্যু যন্ত্রণায় বাঁচার আকুতি জানালেও পাষণ্ড সাগরকে তার লক্ষ্য থেকে এতোটুকুও সরাতে পারেনি। মুমূর্ষু আল আমিনকে হাসপাতালে নেয়ার পরিবর্তে তার মোবাইলফোন কেড়ে নিয়েই সটকে পড়ে অভিযুক্ত খুনি সাগর। হাসপাতালের বেডে তিনদিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে গতকাল বুধবার দুপুরে পরিবার ও স্বজনদের কাঁদিয়ে আল আমিন চলে যায় না ফেরার দেশে। চোখের সামনে একমাত্র ছেলের মৃত্যু যন্ত্রণা দেখা পিতামাতা যেন কোনভাবেই নিজেদেরকে সামলাতে পারছেন না। অভিযুক্ত ঘাতক সাগরকে যেন আল আমিনের চেয়ে কয়েকগুন বেশি কষ্ট দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় সে দাবি নিহতের মায়ের।
মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার শিকার হতভাগা আল আমিন মেহেরপুর গাংনী পৌরসভাধীন চৌগাছা গ্রামের ফলব্যবসায়ী আসমত আলীর ছেলে এবং গাংনী পৌর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রাণনাশকারী কোনো তরল পদার্থ পানের কারণে আল আমিনের কিডনি অকেজো হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা।
এ ঘটনায় গতরাত ১টার দিকে সাগরের সহযোগী কাজিপুর গ্রামের বর্ডারপাড়ার জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে জাহিদুলকে (১৯) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে আত্মগোপনে রয়েছে মূল হোতা সাগর হোসেন। হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত সাগর হোসেন এ উপজেলার কাজিপুর গ্রামের বর্ডারপাড়ার মুক্তার সাহার ছেলে এবং নিহত আল আমিনের পিতা আসমত আলীর আপন খালাতো ভাই। সম্প্রতি সাগর হোসেন মাদক সেবনের পাশাপাশি মাদকব্যবসার সিন্ডিকেটের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার দুপুরে গাংনী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে বসে কৌশলে আল আমিনকে তরল কোনো পদার্থ পান করায় সাগর হোসেন। এর কিছুক্ষণ পরেই শারীরিকভাবে সে এলোমেলো অবস্থার মধ্যে পড়লে তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইলফোন নিয়ে সেখান থেকে সঁটকে পড়ে সাগর হোসেন। স্থানীয় লোকজন আল আমিনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন চিকিৎসক। ওই দিন রাতেই তাকে নেয়া হয় রাজশাহী মেডিকেলে। শরীরে বিষাক্ত কোনো পদার্থের প্রভাবের বিষয়টি বুঝতে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক। তবে শারীরিক অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে গতকাল দুপুরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আল আমিন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি ওয়ার্ডের অধ্যাপক ডা. মনোয়ারুল ইসলামের উদ্ধতি দিয়ে এক চিকিৎসক গতকাল সন্ধ্যায় দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, প্রকৃতপক্ষে আল আমিনকে কি পান করানো হয়েছে তা নিশ্চিত না হলেও প্রাণনাশকারী কোনো তরল পদার্থ পান করানো হয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত তারা। দুই দিন তার শারীরিক অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার মধ্যদিয়ে চিকিৎসা চলছিলো। গতকাল কিডনিতে বিষক্রিয়া মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করেছে মর্মে বুঝতে পারেন চিকিৎসক। সাথে সাথে কিডনি পরিষ্কার (ডায়ালাইসিস) করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়ে চিকিৎসকরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর মাঝেই তার কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। বিষক্রিয়ার প্রভাবে কিডনি ফেল করে তার মৃত্যু হয়েছে বলেও জানান তিনি। আল আমিনের ঠোট ও মুখের বিভিন্ন স্থানে লাল রং ধারণ করেছে। অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে। উগ্র বিষাক্ত কোনো তরল পদার্থের প্রভাবে এমন হতে পারে বলে ধারণা চিকিৎসকদের। তবে লাশের ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে কী খাইয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন করে আজ রাজশাহী থেকে তার লাশ নিজ বাড়িতে আনা হবে বলে জানায় পরিবার।
এদিকে একমাত্র ছেলেকে চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখার সেই দৃশ্য কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না নিহতের পিতা আসমত আলী। চিকিৎসায় সার্বক্ষণিক তিনি ছেলের সাথেই ছিলেন। গাংনী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসায় আল আমিন একটু সুস্থ হলে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পরিবারের কাছে বাঁচার আকুতি জানায়। গতকাল সন্ধ্যায় নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম। আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা নিহতের পরিবারের মতই শোকে পাথর। নিহতের মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। নিমর্ম হত্যাকা-ের আলোচনায় অনেকেই চোখের পানি ফেলছিলেন।
নিহতের মা বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করছিলেন। তিনি জানান, অভিযুক্ত ঘাতক সাগরের সঙ্গে তার ছেলে তেমন কোন পরিচয় কিংবা ঘনিষ্টতা ছিল না। মাস দুয়েক আগে এক আত্মীয়ের বাড়িতে অনুষ্ঠানে গিয়ে সাগরের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পিতার আপন খালাতো ভাই সেই সুবাদে সাগরকে চাচা বলে সম্বোধন করে আল আমিন। চাচা-ভাতিজার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই অনুষ্ঠানে আল আমিনের হাতে একটি অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন দেখে তার নেওয়ার আবদার করে চাচা সাগর। কিন্তু আল আমিন তাতে রাজি হয়নি। সেদিনের মত দু’জন দু’জনের বাড়িতে চলে গেলেও মোবাইল ফোনের লোভ সামলাতে পারছিল না সাগর। অন্যদিকে নেশা ও মাদকের ব্যবসার অর্থের জন্য মোবাইল ফোনটি তার প্রয়োজন হয়ে ওঠে। তাই পরিকল্পনা করে ফোন কেড়ে নেওয়ায়।
রোববার দুপুরে নিজ বাড়িতে ফুফু রোজিফা খাতুনের সাথে টয়লেট তৈরির জন্য গর্ত খুড়ছিলো আল আমিন। এ সময় সাগর তাকে মোবাইলে ফোন করে গাংনী বাজারে আসার অনুরোধ করে। সাগর পারিবারিক নিকটাত্মীয় তাই আল আমিন না করেনি। আল আমিনকে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করার পর তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে পিতামাতার কাছে ঘটনার বর্ণনা দেয়। সাগরের সেই কথার উদ্বৃতি দিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা আরো জানায়, সাগর কৌশলে তাকে কোমল পানীয় বলে বিষাক্ত তরল পদার্থ পান করায়। এর কিছুক্ষণের পরেই আল আমিনের সারা শরীরে জ্বালা-পোড়া শুরু হয়। মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখন মোবাইলফোন নিয়ে পালিয়ে যায় সাগর।
নিহতের বাড়িতে গতকাল তার সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভিড় জমে। পরিবারের মতো তারাও শোকে কাতর। সর্বদা হাসি-খুশি প্রকৃতির সহপাঠীকে কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদে তারা মুখর। যে কোনোভাবে সাগরকে গ্রেফতার পুর্বক দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করেন তারা।
এদিকে গতকাল থেকেই ঘাতক সাগরকে গ্রেফতারে মাঠে নামে পুলিশ। তার বাড়িসহ সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে চালানো অভিযানে তার হদিস না পাওয়া গেলেও তার ফেনসিডিল ব্যবসা সিন্ডিকেটের মূল হোতা কাজিপুর গ্রামের জাহিদুলকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। গাংনী থানার ইন্সপেক্টর (ওসি-তদন্ত) মুক্তার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, জাহিদুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দ্রুত সাগরসহ তার অন্যান্য সহযোগীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজার মুখোমুখি করতে সক্ষম হবে পুলিশ। এ বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও চলছে।
নিহতের পরিবারিক পরিচয়: চৌগাছা গ্রামের শেষপাড়ার আসমত আলী ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার চালানোর পাশাপাশি তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে ছিলেন বেশ আগ্রহী। একমাত্র ছেলে আলামিন এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো। বড় মেয়ে জেসমিন খাতুন ৮ম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে জুলেখা খাতুন ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী। একমাত্র ছেলে, তাই তাকে নিয়ে অনেক আশায় বুক বেঁধেছিলেন মা-বাবা।