মেহেরপুরে বিয়ের সংখ্যা হ্রাস : ডেকোরেটর মাইক্রোবাস ভাড়ার ব্যবসায় মন্দা

মাজেদুল হক মানিক: মেহেরপুরের গাংনীতে মাইক্রোবাস ও ডেকোরেটর ব্যবসায় এখন মন্দাভাব বিরাজ করছে। শীত মরসুমে অন্যান্য বছরে বিয়ের ভাড়া বেশি হলেও এবার বিয়ের সংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে আগের মতো কাজ নেই নিকাহ রেজিস্ট্রারদের (কাজি)। গত কয়েক মাস ধরে জেলায় বাল্যবিয়ে বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অঙ্গীকার করায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

গাংনীর পুর্বমালসাদহ গ্রামের মাইক্রোবাসচালক শামীম আহম্মেদ জানান,  এ অঞ্চলে শীত মরসুমে বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হয়। তবে সারাবছরই কমবেশি বিয়ের ভাড়া হয়ে থাকে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে বিয়ের ভাড়া একেবারেই নেই বললে চলে। মাসে দুয়েকটি ভাড়া হচ্ছে। পিকনিক, রোগী বহনসহ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মাইক্রোবাস ভাড়া হচ্ছে না। গত বছর এই সময়ে প্রতি মাসে মাইক্রোবাস প্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা লাভ ছিলো। এ বছরে লাভের পরিমাণ অর্ধেকেরও কম। চলতি শীত মরসুমে যদি পিকনিকের ভাড়া বেশি না হতো তাহলে বেকার হয়ে যেতাম। শুধু গাংনী শহরের মাইক্রোবাস ব্যবসায়ীদের নয় জেলার বামন্দী, মেহেরপুর ও মুজিবনগর এলাকার ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। জেলায় অর্ধ শতাধিক ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস রয়েছে বলে জানান এর কয়েকজন মালিক।

জানা গেছে, গত ৭ মাস ধরে জেলায় ব্যাপকভাবে বাল্যবিয়ে বিরোধী অভিযান চলছে। বাল্যবিয়ে দেয়া ও বিবাহ দেয়ার চেষ্টার অপরাধে বর-কনের পিতামাতা, গ্রাম্য মোড়ল, কাজি, বিয়ে পড়ানোর মাওলানা ও বাল্যবিয়ের অনুষ্ঠানে সাজ-সজ্জাকারী ডেকোরেটর মালিক এবং বাবুর্চিসহ বাল্যবিয়ের সাথে সম্পৃক্ত কেউই দণ্ডের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাও পালন করছে পুলিশ প্রশাসন।

মাইক্রোবাস চালক ও মালিকরা জানান, বাল্যবিয়ের ঘটনা কমে যাওয়ায় তাদের মাইক্রোবাসের ভাড়া কমেছে। এখন প্রাপ্ত বয়স্ক বর-কনে ছাড়া প্রকাশ্যে বিয়ে হচ্ছে না। তবে দুয়েকটি বাল্যবিয়ে গোপনে হলেও তার ফাঁস হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের কারণে দণ্ডের আওতায় আসছেন অভিভাবক পক্ষ। ফলে এখন বাল্যবিয়ে নামক শব্দটি একটি আতঙ্কের নামে রূপ নিয়েছে।

শুধু মাইক্রোবাস মালিক-চালক নয় ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে ডেকোরেটর ব্যবসায়ীদের। মাসের প্রতি শুক্রবার ও শনিবার বিভিন্ন স্থানে বিয়ের অনুষ্ঠানের সাজ-সজ্জা ও গেট চোখে পড়লেও এখন সে সংখ্যা নেহায়েত হাতেগোনা।  তাই বিয়ের অনুষ্ঠানের ভাড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে অন্যান্য অনুষ্ঠানের ভাড়া নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন ডেকোরেটর মালিকরা।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের ফলে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। তাই ছোটখাটো বিয়ের অনুষ্ঠানেও ডেকোরেটরের মাধ্যমে সাজ-সজ্জা, গেইট ও বরসহ অতিথিদের বসার স্থান করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য অনুষ্ঠানেও এর ব্যবহার বাড়ে। তাই চাহিদা পূরণে উপজেলা শহরের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারগুলোতেও ডেকোরেটর ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। কিন্তু বাল্যবিয়ে বিরোধী কঠোর অভিযানের কারণে ব্যবসায় ছেদ পড়েছে।

জেলায় এখন কোনো কাজি যেমনি ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে ভয় পাচ্ছেন, তেমনি মসজিদের ঈমামরাও বাল্যবিয়ে হলে বিবাহ পড়ানো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বাল্যবিয়ের অনুষ্ঠানেও যেতে অপমাণিত বোধ করছেন নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ। সর্বপরি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের বিষয়টি এখন সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।

জেলা প্রশাসনের হিসেব মতে, বাল্যবিয়ে দেয়া ও বাল্যবিয়ে দেয়ার চেষ্টার অপরাধে গত চার মাসে জেলার ৩টি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৫৮ জন ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা।

শুধু বর-কনে পক্ষ নয় বাল্যবিয়ে কমাতে গাংনী উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে আমতৈল ও কষবা গ্রামে দুই মোড়লকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এতে স্থানীয় মোড়ল-মাতবরাও এখন বাল্যবিয়েতে সহযোগিতা করতে ভয় পাচ্ছেন। গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ব্যবহৃত সরকারি গাড়ির সামনে বাল্যবিয়ে বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যানার সর্বক্ষণ টাঙানো থাকে। রাতে কিংবা দিনে, বাল্যবিয়ের খবর পেলেই উপজেলা নির্বাহী অফিসার কিংবা এসিল্যারন্ড ছুটে যান সেখানে। বাল্যবিয়ের অপচেষ্টাকারীদের কাছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন এক আতঙ্কের নাম হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন। কোনো সুপারিশ বা অনুরোধেরই পাত্তা দেন না তিনি। বাল্যবিয়ের বিষয়ে প্রশাসনের অবস্থান জিরো টলারেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এমনই মন্তব্য এলাকাবাসীর।

শুধু আইন প্রয়োগই নয়, বাল্যবিয়ের কুফল তুলে ধরে তা প্রতিরোধের বিষয়ে জেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক কাতারে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছে প্রশাসন। গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উদ্যোগে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মতবিনিময় করে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অঙ্গীকারও করেছেন তারা।

উপজেলা প্রশাসনের অব্যাহত অভিযান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের কারণে বিয়ে রেজিস্ট্রি গত বছরের চেয়ে এবার অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান গাংনী পৌর নিকাহ রেজিস্ট্রার হুজ্জাতুল ইসলাম ফয়সল। তিনি বলেন, গাংনী পৌর এলাকায় ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৭টি বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়। এর এক বছর পরে এর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে ২৮টি। প্রশাসনের কঠোরতার আগে তারা কনের জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখে রেজিস্ট্রি করতেন। এখন বর-কনে ছাত্রছাত্রী হলে তাদের পরীক্ষার সনদপত্র যাচাই করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা জন্ম নিবন্ধনে ইচ্ছেমতো বয়স উল্লেখ করে থাকেন। এখন সেটি আর আমলে নেয়া হচ্ছে না। বাল্যবিয়ের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে থাকায় নিকাহ রেজিস্ট্রির সংখ্যাও কমে গেছে।

গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন জানান, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে চলমান এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোনোভাবেই বাল্যবিয়েকে ছাড় দেয়া হবে না। শুধু অভিযান নয় বাল্যবিয়ের বিষয়টি একেবারেই নির্মূল করার জন্য জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে জেলায় একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ছেলেমেয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করা হবে। যাতে একটি পরিবার তার ছেলে-মেয়েকে বোঝা মনে না করে। আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর জেলাকে বাল্যবিয়েমুক্ত ঘোষণা করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।