মামলা ॥ সালিস করা ইউপি মেম্বার ও কাজি গ্রেফতার

গাংনীতে সালিসে নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক বিরূপ আলোচনা

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার করমদি গ্রামে সালিসের নামে গৃহবধূ ও যুবককের নির্যাতনের ঘটনায় অবশেষে মামলা দায়ের হয়েছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নির্যাতিত নারীর পিতা বাদি হয়ে ১৭ জনকে আসামি করে গাংনী থানায় মামলাটি দায়ের করেন। পুলিশের তড়িত পদক্ষেপে এক ইউপি মেম্বার ও কাজিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন- করমদি গ্রামের মৃত চেতন ম-লের ছেলে তেঁতুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল হামিদ (৫২) ও একই গ্রামের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) রমজান আলীর ছেলে শিহাব উদ্দীন (২৫)। গতকাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি চলছে। নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। নির্যাতিতা গৃহবধূর পাশে দাঁড়িয়েছে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, মানবাধিকার সংগঠন মউকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মতর্কা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, গতকাল দিনভর বিভিন্নভাবে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হয়। তদন্তে ঘটনার সত্যতা মেলে। গ্রাম্য মতবর কিংবা জনপ্রতিনিধিদের এ ধরনের বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তাছাড়া নির্যাতন করাতো অন্যায়। ভিডিও ফুটেজ ও ছবি নির্যাতনের বড় প্রমাণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্যাতিতা গৃহবধূর পিতা বাদি হয়ে গতকাল সন্ধ্যায় গাংনী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। সালিসের নামে নির্যাতনকারীদের ১৭ জনকে তিনি আসামি করেন। পুলিশের তাৎক্ষণিক অভিযানে আসামি দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ বিচারকদের একজন ছিলেন। অপরদিকে নিকাহ রেজিস্ট্রার রমজান আলীর ছেলে গৃহবধূ এবং ওই যুবকের তালাকনামা সম্পন্ন করেছিলেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এছাড়াও তাদের স্বীকারোক্তিতে অভিযুক্ত সালিসপতিদের নাম পাওয়া গেছে। তবে মামলা তদন্ত এবং আসামি গ্রেফতারের স্বার্থে তাদের নাম পরিচয় গোপন করেন তিনি।
বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিমের ৩/৪টি দল অভিযানে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রধান আসামিসহ অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি মেহেরপুর জেলা প্রশাসন ও গাংনী উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখেছি। এই নির্যাতন ও অবিচারের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার অসুস্থ্য থাকায় গাংনী সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম জামাল আহম্মেদকে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গায় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের গুরুত্ব দিয়ে মানবাধিকার সংগঠন-আমঝুপি মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের (মউক) তিন সদস্যর একটি দল নওপাড়া গ্রামে নিয়ে নির্যাতিতা গৃহবধূর সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের তদন্তে ঘটনার প্রাথমিক সতত্যা পাওয়া গেছে। এ তথ্য জানিয়ে মউক নির্বাহী প্রধান আসাদুজ্জামান সেলিম জানান, ওই নারী এবং তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন। তাদেরকে আইনী সহায়তা প্রদান করা হবে। এ ধরণের বর্বরোচিত ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন। সালিসের নামে নির্যাতনকারীদের সাজা দাবি করেন তিনি। তদন্ত দলে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী সাদ আহম্মেদ, ফাহিমা আক্তার ও কাজল রেখা। তবে গৃহবধূর তার স্বামীর সংসারে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মানবাধিকার সংগঠন  প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল সংবাদ প্রকাশ হলে অভিযুক্তদের অনেকেই গাঢাকা দেন। সময় গড়ানোর সাথে সাথে প্রশাসনের তৎপরতা আরও বাড়তে থাকে। তাই গ্রেফতার এড়াতে তারা আত্মগোপন শুরু করেন। তবে প্রশাসনের পদক্ষেপে ভুক্তভোগী ও এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। সামাজিক বিচারের নামে নির্যাতন বন্ধ করতে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।
প্রসঙ্গ, গেলো ১ জুলাই রাতে করমদি গ্রামের প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে একই গ্রামের এক যুবকের পরকীয়া প্রেমের অভিযোগে আটক করে গ্রামের কতিপয় লোকজন। পরদিন  গ্রামের অংসখ্য মানুষের উপস্থিতে তাদের দু জনের হাত একসাথে রসি দিয়ে বেঁধে গ্রামের সড়ক ঘোরানো হয়। শারীরিক নির্যাতনেরও অভিযোগ ওঠে। ওই সালিসেই গৃহবধূকে যুবকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। ওই যুবককে দেড় লাখ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করে গৃহবধূকে আবার তালাক দেয়া হয়। ইউপি চেয়ারম্যান, ৮নং ওয়ার্ড সদস্যসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সালিসের নামে অবিচারের অভিযোগ ওঠে। বেঁধে গ্রাম ঘুরানোর ভিডিও এবং ছবি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়।