মানুষের নিষ্ঠুরতায় প্রকৃতি থেকে বিলীন হচ্ছে বিষধর সাপ

মহাসিন আলী: ‘নাগিনী-সাপিনী আয় তোরা আয়; ভালো বেসে কাছে এসে ধরা দে আমায়।’সাপ নিয়ে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অনেক নাটক-সিনেমা নির্মিত হয়েছে। রচিত হয়েছে অনেক গান। এক সময় সাপ নাচিয়ে ও সাপ দেখিয়ে ওঝা-বেদেরা আয়-রোজগারে মেতেছিলো। টাকা আদায়ে বেদেনী সাপকে উদ্দেশ্য করে গান গাইতো‘খা খা বক্কিলারে খা; কাঁচা ধইরা খা—-’তাদের রোজগারে চলতো তাদের বড় সংসার। মানুষের নিষ্ঠুর আচারণ আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আজ আর সেই সাপ চোখে পড়েনা। সাপ ছাড়াই হিন্দি চলচিত্রে ‘নাগিন নাগিন; নাগিন নাগিন এড্যান্সে নাচনা —-’গান করতে দেখা যায়।

বিষধর সাপের মধ্যে পদ্ম গোখরা অন্যতম। যাদের আবাসস্থল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ও মানুষের নিষ্ঠুরতার কাছে বিলীন হতে বসেছে এ বিষধর পদ্ম গোখরা। বন-জঙ্গল আর উঁচু ঢিবিতে এ সাপের বসবাস। বন উজাড় হতে চলেছে। উঁচু ঢিবি কেটে সমান করে সেখানে চাষাবাদ করছে মানুষ। বিষাক্ত সাপ জেনে দেখা মাত্র একে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে মানুষ। এসব কারণে দিনে দিনে এ সাপ বিলীন হতে চলেছে।

অতীতে কাজি নজরুল ইসলাম রচনা করেছেন পদ্ম গোখরা। সাপ না থাকলে পল্লীকবি জসিমউদ্দিন হয়তো বেদের মেয়ে জোসনা রচনা করতেন না। ইবনে মিজানের প্রতিটি চলচিত্রে মিলতো সাপের দেখা। হিন্দি ছবির খল নায়ক ওমরেশ পুরির নাম করলে অনেক সাপের ছবির কথা মনে পড়ে দর্শকের। নদী মাতৃক বাংলাদেশে বেদেদের নৌকার পাশাপাশি অন্যতম পুঁজি ছিলো সাপ। নদীতে পানি শুকিয়ে গেছে। সাপ সংগ্রহও দূরাহ হয়ে পড়েছে। তাই দিনে দিনে অনেক বেদে পরিবার তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে। আগের মতো বেদে নারীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সাপ নাচিয়ে আর গাছড়া দিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করতে দেখা যায়না। গ্রাম-গঞ্জের হাটে-ঘাটে ওষুধ বিক্রেতা আর সাপ নাচিয়ে লোক জড় করে ওষুধ বিক্রি করেন না। এখন বেদের বহরে সাপের পরিবর্তে বানর নাচাতে দেখা যায়।

যশোরের শার্শা উপজেলার বনরাজ সর্দ্দার প্রায় তিন দশক আগে মেহেরপুরে এসে শহরের ঈদগাপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন। মেহেরপুরে তিনি বেশ কয়েকজন শীর্ষ তৈরি করেন। তারা জানান, ওস্তাদের সাথে মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। বিষধর পদ্ম গোখরা সাপ ধরেছি। সাপে কাটা রোগী ঝাড়ান-কাড়ান করেছি। সংসার চালানোর জন্য টাকা পাইতাম। এখন আর সাপ ধরার জন্য ডাক আসেনা। ঝাড়ান-কাড়ান করার জন্য সাপে কাটা রোগী পাইনা। মাঝে মধ্যে দু-একটা সাপে কাটা রোগীর কথা শোনা গেলেও তাদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে শোনা যায়। বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে রিকসা চালাচ্ছি। আবার কেউ অন্যের দোকানে অথবা ক্ষেতে খামারে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে।

মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান বললেন, ঝাড়ান-কাড়ানে সাপে কাটা রোগী সুস্থ হয়না। বিজ্ঞানের মতে- বিষধর সাপে কামড়ালে ওঝা-বেদের সাধ্য নেই বাঁছাতে পারে। তখন তারা বলেন, কালে কেটেছে বলে বাঁচানো গেলো না। তিনি আরো বলেন, সাপ ৩ প্রকার। নির্বিষ সাপ, বিষধর সাপ ও তীব্র বিষধর সাপ। নির্বিষ সাপে কামড়ালে মানুষ মরেনা। বিষধর সাপে কামড়ালে শরীরের বিষ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বিষের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। তার ওপর রোগীর মরা-বাঁচা নির্ভর করে। তবে বিষধর সাপে কামড়ালে ঝাড়ান-কাড়ানে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য। তাই যে কোনো সাপে কামলাড়ে প্রতিরোধে ওঝা-বেদের স্মরণাপন্ন না হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেন তিনি।

বন্দর গ্রামের বৃদ্ধ সাদেক হোসেন জানান, সাপ নাচানো অর্থাৎ সাপের খেলা এক সময় বাঙালির অন্যতম বিনোদন ছিলো। প্রকৃতি থেকে সাপ হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই আগের মতো আর সাপ খেলা দেখা যায়না।

খুলনা সরকারি ব্রজ লাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএল কলেজ) প্রাণি বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. একেএম নজরুল কবীর বলেন, সাপ একটি নিরীহ প্রাণি। আত্ম রক্ষার্থে ছাড়া সাপ সহজে মানুষকে কামড়ায় না। অকারণে সাপ দেখলে নির্বিচারে আমরা তাদের মারি। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাপের ভূমিকা কম নয়। সাপ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। প্রয়োজনে সাপের জন্য লাউছড়া বন কিংবা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের মতো আরো অনেক গুলো অভয়ারণ্য তৈরি করে সাপ সংরক্ষণ করা যেতে পারে।