ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণার পরও প্রকশ্যে ভিক্ষাবৃত্তি ॥ পুলিশের ভয় দেখিয়েও ফেরানো যাচ্ছে না বাড়ি

চুয়াডাঙ্গা জান্নাতুল মওলা কবরস্থানের সামনে বাদজুম্মা ভিক্ষুক দেখে পৌর কাউন্সিলরের বিশেষ উদ্যোগ ॥ দর্শকদের দীর্ঘশ্বাস

স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশের ভয় দেখিয়েও ফেরানো যায়নি বাড়ি, উল্টো প্রশ্ন তুলে বলেছে, ভিক্ষা করতে না দিলে খাবো কি? গতপরশু শুক্রবার বাদজুম্মা চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের জান্নাতুল মওলা কবরস্থান জামে মসজিদের সামনে ভিক্ষার হাতপাতা কয়েকজন নারী-পুরুষ ভিক্ষুককে পৌরসভার এক কাউন্সিলর পুলিশের ভয় দেখিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি না করার অনুরোধ জানালে ভিক্ষকুরা প্রশ্নই শুধু তোলননি, তারা অভিযোগ করে বলেছেন, শুনেছি কতোজনকেই তো কতোকিছু দেয়া হয়েছে। আমাদের তো কিছুই দেয়া হয়নি। অবশ্য এক অন্ধু ভিক্ষুক বলেছেন, দু হাজার টাকায় কি কিছু হয়? দু হাজার টাকা হাতে তুলে দিয়ে যেদিন বলা হলো, ভিক্ষা করা যাবে না, সেদিনই ওই টাকা ফেরত দিয়েছিলাম। পরে দেখি লোক দিয়ে মেম্বার ওই টাকা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলাকে গত ১০ এপ্রিল আর চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকাকে গত ১৩ এপ্রিল ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। জেলা প্রশাসক এ ঘোষণা করলেও বহু ভিক্ষুক প্রকাশ্যেই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন। কেউ কেউ পথের পাশে গড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে পথচারীদের কৃপা কুড়িয়ে দিব্যি গুনছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। শোানা যায়, এ ধরনের ভিক্ষুকের সন্তানদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাও জমানো হচ্ছে লাখ লাখ। যাদের হাত পেতে টাকা কামানো নেশায় পরিণত হয়েছে, যাদের অভাবের চেয়ে হাত পাতা স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফেরাবেন কীভাবে? জেল-পুলিশের ভয়? তাতেও তেমন সাড়া মিলছে না, বরঞ্চ উল্টো অভিযোগের মাত্রা বাড়ছে। অভিযোগের অংশ বিশেষ অবশ্য চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মনি স্বীকারও করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার এলাকার ৪৭ জন ভিক্ষুকের তালিকা করে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ১০ জনের নাম বাদ যাওয়ায় তারা কিছু পাননি। ফলে ওরা যদি কিছু না পাওয়ার অভিযোগ করে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘোরে তাহলে আমার আর কি বলার আছে বলুন!
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের সরকারি কলেজ রোডে জান্নাতুল মওলা কবরস্থান। এ কবরস্থানের মেনগেটের সামনে প্রতি শুক্রবার বাদজুম্মা সারিবদ্ধ হয়ে বহু ভিক্ষুক ভিক্ষা করেন। দেশ ভিক্ষুকমুক্ত কর্মসূচি হাতে নেয়ার পর সে সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেলেও এখনও শূন্যে নামেনি। গতপরশু শুক্রবার জান্নাতুল মওলাকবরস্থানের নামনে ৮-৯ জন নারী-পুরুষ ভিক্ষুক ভিক্ষার থালা-ঝুলি নিয়ে বসলে পৌরসভার একজন কাউন্সিলর তাদের ভিক্ষা না করে বাড়ি ফেরার জন্য অনুরোধ জানান। তাতে সাড়া না পেলে তিনি পুলিশের ভয় দেখান। তাতেও কোনো কাজ না হলে কাউন্সিলর ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, যাদের স্বভাব ভিক্ষা করা তাদের কি পেট ভরানো যায়? অবশ্য পরে খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, গতপরশু যারা জান্নাতুল মওলা কবস্থান জামে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষার হাত পেতে বাধার মুখে পড়েন তাদের মধ্যে ৪ জন নারী বসবাস করেন ফার্মপাড়ায়। একজন হকপাড়ায়। শারীরিক প্রতিবন্ধীর বাড়ি মোমিনপুর ইউনিয়নের পিটিআই মোড়ের অদূরে। আর মুন্সিগঞ্জের এক নারী জান্নাতুল মওলা কবরস্থানের পাশে না থাকলে তাকে স্টেশনের এক কোণে বসে মালসাভর্তি বহু টাকা গুনতে দেখা গেছে। ওই নারী প্রতিবন্ধী না হলেও তিনি রাস্তায় গড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিক্ষা করেন। কেন তিনি ভিক্ষা করছেন এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি নীরব থাকেন। মেয়ের নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকার প্রসঙ্গটি সামনে আনলে তিনি ফুঁসে ওঠেন। কবরস্থানের সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করা শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবুর আলী বলেন, আমি মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে ঘুরে কিছুই পাইনি। প্রতিবন্ধীভাতা দেয়। তাতে কি সংসার চলে। তাইতো ভিক্ষা করছি। চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়ার মৃত ইছানুলের বাড়িতে বেশ ক’জন ভিক্ষুক ভাড়ায় বসবাস করেন। গতকাল এ বাড়িতে গেলে দেখা যায়, কেউ রান্না নিয়ে ব্যস্ত, কেউ তুলছেন নারকেল পাতার খিল। ক্যামেরা তাক করতেই কয়েক নারীর অভিন্ন প্রশ্ন- ভিক্ষা করবো না তো কি করে খাবো?
ব্যবসা করার জন্য টাকা দেয়নি? পাল্টা এ প্রশ্নের জবাবে কেউ থেকেছেন নীরব, কেউ বলেছেন শুনেছি কতোজনই তো পেয়েছে, আমাদের তো কেউ কিছুই দেয়নি। অবশ্য একজন নারী বললেন, টাকা দিয়ে কি হবে। দু দিনেই তো ফুরিয়ে যাবে। বেলগাছি ঈদগাপাড়ার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আশিক বলেছেন, আমাকে ডেকে নিয়ে দু হাজার টাকা দিতে গেলে আমি তা না নিয়ে বাড়ি ফিরি। পরে মেম্বার সেই টাকা একজনের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলুন তো, দু হাজার টাকায় কি কিছু হয়? আমাকে বলা হলো চা বিক্রি করো। আমি একা চলতে পারিনে, একজনকে হাজরে দিয়ে আমাকে চলতে হয়। চা ফেরি করে কি একজনের হাজরে দিয়ে চলা সম্ভব? তাই তো ভাই ভিক্ষা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। হকপাড়ায় ভাড়ায় বসবস করা তহমিনারও অভিন্ন অভিমত।  কেন ভিক্ষা করতে হয়? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে নারী ভিক্ষুকদের মধ্যে নাজমা, ফাতেমা, মাজেদাসহ নারী ভিক্ষুকদের প্রায় সকলেরই মন্তব্য, বিয়ের পর দু-তিনটে সন্তান দিয়ে স্বামী নিরুদ্দেশ। কী করে খাবো? বাধ্য হয়েই ভিক্ষা করতে রাস্তায় বের হতে হয়েছে। সন্তান বড় হয়ে এখন খোরাকি দেয় না? অধিকাংশেরই জবাব, ওদেরই চলে না। তাই তো, যখন শুনেছি সরকার টাকা দেবে, ভিক্ষা আর করতে হবে না, তখন খুশি হয়েছি। পরে দেখি এক-দু হাজার টাকা আর ছাগল-টাগল কিনে দিচ্ছে। ওতে কি পেট চলে?
জানা গেছে, গত ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণার সময় জানানো হয়, পৌর এলাকার তালিকাভুক্ত ১৬০ জন ভিক্ষুকের পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ নং ওয়ার্ডে ৭ জন, ২ নং ওয়ার্ডের ১৭ জন, ৪ নং ওয়ার্ডের ৫ জন, ৬ নং ওয়ার্ডের ১৬ জন, ৭ নং ওয়ার্ডের ১৪ জন, ৮ নং ওয়ার্ডের ৩৭ জন ও ৯ নং ওয়ার্ডের ৩৪ জন। সদর উপজেলার ১৫০ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে শুধু নগদ টাকাই নয়, ব্যবসার কিছু উপকরণও কিনে দেয়া হয়। নারীদের কিনে দেয়া হয় ছাগল। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে দাবি সচেতনমহলের। তাদের মন্তব্য, এক দু মাসের মধ্যেই তো আর ভিক্ষুকমুক্তকরণ কর্মসূচি শতভাগ সফল করা সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তির নেপথ্য খতিয়ে দেখে কারণ বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারলে স্থায়ী সমাধান সম্ভব। যদিও ভিক্ষুকমুক্ত সমাজ গঠন এখনই শতভাগ না হলেও লক্ষ্য পূরণের পথে হাঁটা তো শুরু হয়েছে। এ মন্তব্য করে ভিক্ষুকমুক্ত সমাজ গঠনের কর্মসূচিকে অনেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন।