ভারত থেকে আমদানিকৃত লাল-সবুজ রঙের রেলকোচের ২য় চালান দেশে আনা হলো

 

দর্শনা অফিস: ১৩ দিনের মাথায় ভারত থেকে আমদানিকৃত জাতীয় পতাকা মতো লাল-সবুজ রঙের রেলকোচের ২য় চালানে ২০টি কোচ দেশে আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ রেলকোচ আনা অব্যাহত থাকবে। দর্শনা আন্তর্জাতিক স্টেশনে এ কোচ পৌঁছুলে কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেন। গতকাল সোমবার দুপুর ১টার দিকে ২য় চালানের ২০টি বগি দর্শনা আন্তর্জাতিক স্টেশনে পৌঁছায়। এ পর্যন্ত ২ দফায় রেলকোচের চালান আনা হলো ৪০টি। এবারের চালানে রয়েছে- এসি সিলিপার প্রথম শ্রেণি ৩টি, এসি চেয়ারকার প্যান্টি ৩টি, ননএসি প্যান্টি ৭টি, গার্ডরুম ১টি এবং ননএসি চেয়ারকার প্রেয়াররুম ৬টি। বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশি পশ্চিম জোনের ইঞ্জিনিয়ার ফকির মহিউদ্দিন ও শেখ হাসানুজ্জামানের কাছে ভারতীয় রেলওয়ে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর এনটাটেঞ্জ পার্থ ব্যানার্জি ও অশোক বিশ্বাস ভারতীয় ২০টি বগি বুঝিয়ে দেন। এ চালানের বগিগুলো দর্শনা আর্ন্তজাতিক স্টেশনের ইয়ার্ডে রক্ষিত রয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে সৈয়দপুরের উদ্দেশে নেয়া হতে পারে। গত ২২ মার্চ প্রথম চালানে ছিলো ৩টি পাউয়ারকার, ৬টি এসি চেয়ার ও ৩ স্লিপার কোচ এবং ননএসি ৮টি চেয়ার কোচ। অত্যাধুনিক ও বিলাস বহুল কোচগুলো রেলওয়ের ব্রডগেজের জন্য তৈরি। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কোচগুলো পরীক্ষামূলকভাবে আন্তঃনগর ট্রেনের সাথে যুক্ত করা হবে। কোচগুলো দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছুনের আগেই তা গ্রহণের জন্য স্টেশনে পৌঁছান বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। কর্মকর্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- রেলওয়ের পশ্চিম জোন রাজশাহীর অ্যাডিশনলাল চিফ মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার ফকির মহিউদ্দিন, ডিভিশনাল ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার শেখ হাসানুজ্জামান, দর্শনা কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার আবুল ইসলাম, কাস্টমস সুপার মোস্তফা কামাল চৌধুরী, দর্শনা আন্তর্জাতিক স্টেশন মাস্টার মীর লিয়াকত আলী প্রমুখ।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এভাবে পর্যায়ক্রমে ভারত থেকে মোট ১২০টি কোচ আনা হবে ব্রডগেজের জন্য। আর মিটার গেজের জন্য ১শ টি কোচ আনা হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ভারতের পাঞ্জাবের কাপুরথালা কারখানা থেকে কোচগুলো তৈরি করা হয়েছে। অস্ট্রিয়ান টেকনোলজিতে তৈরি বিলাসবহুল এই কোচগুলো লিঙ্ক হোপম্যান বুশ (এলএইচবি) ব্রান্ডের। ভারতের বিলাসবহুল সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন রাজধানী এক্সপ্রেস ও শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনে এই কোচগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এলএইচবি কোচের চেয়ার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ অত্যন্ত আরামদায়ক। এছাড়া এ প্রথম শোভন চেয়ার শ্রেণিতে থাকছে খাবার মজুদের (প্যানট্রিকার) স্থান এবং নামাজের জায়গা। এতে করে যাত্রীরা খাবারের অর্ডার দেয়ার সাথে সাথে খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ব্রডগেজের জন্য তৈরি ১২০টি কোচের মধ্যে শোভন চেয়ার শ্রেণির ৩৪টি কোচ থাকছে। ৩৪ টির মধ্যে ১৭টি কোচে খাবার মজুদের স্থান (প্যানট্রিকার) থাকবে। বাকি ১৭টিতে থাকবে নামাজের জায়গা। অর্থাৎ যে কোচে খাবার মজুদের ব্যবস্থা থাকবে সেখানে নামাজের জায়গা থাকবে না। যাত্রীদের সুবিধার্থে এই দুই ধরনের কোচ পরপর সংযোজন করা হবে। যাতে দুই ধরনেরই সুবিধা পেতে পারে ট্রেনযাত্রীরা। যাত্রীদের বিলাসবহুল সেবা প্রদানের জন্য ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করা জরুরি। বিষয়টা মাথায় রেখে লাল-সবুজ স্টিল কোচের যে বহর সাজানো হয়েছে তাতে প্রতিটি ট্রেনের সামনে এবং পেছনে দুটি করে পাউয়ার কার থাকবে। বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে একটা পাউয়ার কার ট্রেনের মাঝখানের অংশে থাকে। অন্যদিকে এসি বার্থ এবং এসি চেয়ার শ্রেণিগুলো হবে অত্যন্ত বিলাসবহুল আরামদায়ক। বার্থগুলোর সেবার মান হবে অনেকটা তিন তারকা হোটেলের মতো। খাবারের পাশাপাশি বই পড়ার ব্যবস্থাও থাকবে। এসির পাশাপাশি ননএসি বার্থ এবং প্রথমশ্রেণিও থাকবে। এসি-ননএসি চেয়ারেও যাত্রীরা আরাম করে ঘুমানোর সুযোগ পাবে। চলতি বছরের মধ্যে রেলের বহরে যোগ হচ্ছে বিলাসবহুল ২৭০টি কোচ। বাংলাদেশের পতাকার সাথে মিল রেখে স্টেইনলেস স্টিলের কোচগুলোর রঙ নির্ধারণ করা হয়েছে লাল-সবুজ। ২৭০টি কোচের মধ্যে ১৫০টি কোচ আনা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া এবং ১২০টি আসছে ভারত থেকে। মিটার গেজের জন্য একশটি এবং ব্রডগেজের জন্য ৫০টি কোচ আনা হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ভারত থেকে ১২০টি কোচ সবগুলোই ব্রডগেজের জন্য। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দুটি দেশের কোচই স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। বিলাসবহুল, আরামদায়ক, টেকসই এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম। ওজনে অপেক্ষাকৃত হালকা বলে গতিবেগ হবে অধিক বেশি। কোচগুলো রেলের বহরে যুক্ত হলে ট্রেনের গতি ও যাত্রী সেবার মান বাড়বে।

রেলওয়ের যাত্রীসেবার মান আধুনিকায়ন, নিরাপদ ও আরামদায়ক করার লক্ষ্যে ২৭০টি নতুন যাত্রীবাহী কোচ ও ১০টি ইঞ্জিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত বছরের নভেম্বর মাসে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এজন্য পৃথক দুই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদিত প্রকল্প দুটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ১শ ৮ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের মধ্যে সরকারের ৫৭৪ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকল্প সাহায্য হিসেবে দেবে। প্রকল্প দুটির মধ্যে ১ হজার ৩৭৪ কোটি টাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য মিটারগেজ এবং ব্রডগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ সংগ্রহ নামক প্রকল্পের আওতায় ২৭০টি কোচ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া কোচগুলো ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ২টি ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্ট এ প্রকল্পের আওতায় কেনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। একনেকের ওই সভায় ৭৩৪ কোটি টাকার বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য লোকোমোটিভ রিলিফ ক্রেন এবং লোকোমোটিভ সিমুলেটর সংগ্রহ নামক অপর একটি প্রকল্পের আওতায় ১০টি ইঞ্জিন, ৪টি অ্যাকসিডেন্ট রিলিফ ক্রেন এবং একটি লোকোমোটিভ সিমুলেটর কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ইন্দোনেশিয়ার কোচগুলো বিলাসবহুল এবং এগুলোর হুইল (চাকা) সিয়াট কোম্পানির। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি কোচগুলো অপেক্ষাকৃত হালকা। চলাচলের সময় খুব বেশি শব্দ হবে না। ওজনে হালকা হওয়ায় কোচগুলো টানতে ইঞ্জিনের শক্তি লাগবে কম। এতে ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘন্টায় ১৬০ কিলোমিটার। দীর্ঘস্থায়ী কোচগুলো রক্ষণাবেক্ষণের খরচও খুব কম।

রেলওয়ের মিটারগেজে বর্তমানে চলার উপযোগী ১ হাজার ১৬৫টি যাত্রীবাহী কোচ আছে। এর মধ্যে ৫৯১টির অবস্থা ভালো নয়। এ কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ে আরামদায়ক ও নিরাপদ যাত্রীসেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সে কারণে মিটার গেজের জন্য বেশি আনা হচ্ছে এ কোচ। অন্যদিকে, ব্রডগেজে চলার জন্য রেলওয়ের ৩২৪টি কোচ রয়েছে, যার মধ্যে ৭৮টির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।