ভাগ্নেকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন মামাও

স্টাফ রিপোর্টার: আগুন লাগার পরপরই বেরিয়ে গিয়েছিলেন মামা রাশেদ। কিন্তু তিনতলায় থেকে ভাগ্নে নাঈম ফোন করে জানালেন তিনি আটকা পড়ে আছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ভাগ্নেকে উদ্ধার করতে গেলেন মামা। কিন্তু না, দুজনের কেউই বাঁচতে পারেননি। তবে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত একসাথে থেকে মামা-ভাগ্নের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আরও একবার প্রমাণ করে গেছেন রাশেদ ও নাঈম।

গাজীপুরের শ্রীপুরে আসওয়াদ নিটিং অ্যান্ড ডায়িং কারখানায় সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) ছিলেন রাশেদুজ্জামান। তার ভাগ্নে নাঈম ছিলেন একই কারখানার কমর্চারী। নাঈমকে তিনিই এ কারখানায় চাকরি দিয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে কারখানায় যখন আগুন লাগে, তখন মামা-ভাগ্নে দুজনই কাজ করছিলেন। গতকাল বুধবার রাতে যখন কারখানার দ্বিতীয় তলা থেকে একসাথে মামা-ভাগ্নের লাশ উদ্ধার করা হয়, তখনো কারখানার পেছনে আগুন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। চারপাশে পোড়া গন্ধ। লাশ নিতে আসা স্বজনদের আহাজারি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই কারখানার অপারেটর শামীম মিয়া বলেন, ‘রাশেদ স্যার দোতলায় কাজ করছিলেন। বিকেল পৌনে ৬টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। এর পরই আগুন দেখেন। দ্রুত তারা সবাই নিচে নেমে আসেন। কারখানার তিনটি গেট দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় সবাই নিচে এসেছিলেন। এর মধ্যে রাশেদ স্যারও ছিলেন। কিন্তু হঠাত করেই তার মোবাইলে ফোন আসে। তিনি জানান, নাঈম আটকা পড়ছে তিনতলায়। দ্রুত রাশেদ স্যার নাঈমকে উদ্ধার করতে চলে যান। এর মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তারা কেউই আর বের হতে পারেননি।

পলমল গ্রুপের পোশাক কারখানা আসওয়াদ নিটিং অ্যান্ড ডায়িং। পলমল গ্রুপের এক পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আগুন লাগার পরপরই প্রায় সব কর্মী বেরিয়ে গিয়েছিলেন। নাঈম কোনো একটা সুইচ বন্ধ করতে তিনতলায় গিয়েছিলেন। তাই তিনি আটকা পড়েন। রাশেদ এর আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে নাঈমের ফোন পেয়েই তিনি আবার কারখানায় ঢোকেন। কিন্তু ততক্ষণে সুতা ও কাপড়ে আগুন ধরে দ্রুত সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছিলো। কেউ তাই আর বের হতে পারেননি।

রাশেদুজ্জামানের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ি গ্রামে। রাত দেড়টার দিকে যখন মামা-ভাগ্নের লাশ বের করে আনা হয়, তখন অনেকেই ধরে রাখতে পারেননি চোখের পানি। রাত ২টার দিকে স্বজনদের কাছে লাশ বুঝিয়ে দেয় শ্রীপুর উপজেলা প্রশাসন। রাশেদের স্ত্রীর বড় ভাই তোফায়েল আহমেদ ও চাচাতো ভাই মোহাম্মদ মাহফুজ লাশ নিয়ে যান।

মোহাম্মদ মাহফুজ বুধবার সকালে জানান, রাশেদের দাফনকাজ চলছে। তিনি জানান, আট বছর আগে রাশেদ বিয়ে করেছেন। তার দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। বড়টির বয়স তিন ও ছোটটির এক বছর। রাশেদ ও নাঈম ছাড়াও আগুনে পুড়ে আরও সাতজন মারা গেছেন। আগুনে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে নিহতদের মধ্যে খলিল, রুবেল ও রাজু রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সহকর্মীরা। সকালে নিহত ব্যক্তিদের আরও কয়েকটি পরিবার লাশ বুঝে নিতে কারখানার পাশে জড়ো হয়েছেন। তবে নিহত পাঁচটি লাশ এখনো শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই রাখা হয়েছে।

আসওয়াদ কারখানা কর্তৃপক্ষ ও অগ্নিনির্বাপনকর্মীরা জানান, নিটিং সেকশনের দোতলায় থাকা একটি স্ট্যান্ডার্ড মেশিন অতিরিক্ত গরমে বিস্ফোরিত হলে পাশে থাকা মালামালে আগুন ধরে যায়। মঙ্গলবার বিকেলে আগুন লাগলেও সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের দীর্ঘ সময় লাগে। বুধবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিকাণ্ড তদন্তে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দিলরুবা খানকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে মঙ্গলবার রাত থেকেই বিপুলসংখ্যক ৱ্যাব ও পুলিশ সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। সকাল থেকে শ্রমিকেরা কারখানার চারপাশে ভিড় করে আছেন।

কারখানার কয়েকজন কর্মী জানান, এ কারখানার বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভালো। তাই এখানে যারা চাকরি করতেন সহজে ছাড়তেন না। তারা জানান, ৮ তারিখে বেতন হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই বোনাস হওয়ার কথা। কিন্তু ঈদের আগে এমন আগুন লাগায় তারা এখন ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় আছেন।