ভণ্ড কবিরাজের ভণ্ডামি মার্কা উক্তি : ঘরে রাখা বোতলে বন্দি ৫১২ জিন

 

কামরুজ্জামান বেল্টু: উঁচু চটকাগাছের মগডাল থেকে নামিয়ে হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টার মাথায় কিশোর কাওছারকে নেয়া তার মামাবাড়ি ডিঙ্গেদহের মানিকদিহি। সেখানে শুরু হয় জিন-পরী তাড়ানোর নামে নাটক। যতোবারই কথিত কবিরাজ জালাল উদ্দীন বেত্রাঘাতের সাথে সাথে জানতে চেয়েছে না, ততোবারই কাওছার তার নিজের নামটাই শুদ্ধ করে বলেছে। কোথা থেকে এসেছি বলে প্রশ্ন করতেই কাওছার বলেছে হাসপাতাল থেকে।

কবিরাজের নাটকে কিশোর কাওছার যখন বেকে বসেছে তখন কবিরাজ জালাল উদ্দীন বলতে শুরু করেন, ‘গায়ে ভর করেনি দূর থেকে দৃষ্টি ধরছে। একটা বোতল দাও, ওই বোতলে জিনটাকে ভোরে দিই।’ বোতল দিতেই কবিরাজ মন্ত্র পড়ে জিনটাকে বোতলে ভোরার মনগড়া গল্প বলে সকলকে বোকা বানান। ঘটনাটি ঘটে পরশু রাতে। গতকাল কিশোর কাওছার অবশ্য তার মামার দোকানে বসে দায়িত্ব পালন করেছে। এ সময় তার সাথে একান্তে কথা বলতে গেলে সে প্রথমে বলে, ‘দোকানের পাশের বাড়ির ছেলে শিশু তাজকে সাথে নিয়ে বেগুনক্ষেতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার সময় আমগাছে উঠি। এরপর দেখে একজন মেয়ে এসে আমাকে নিয়ে গেলো। পাটিতে শুতে দিলো। কয়েকটি ফল খেয়ে পাটিতে শুয়ে ছিলাম। পরে দেখি আমি হাসপাতালে।’ এ কথা শুনে কাওছারকে সাথে করে শিশু তাজের নিকট গেলে শিশু তাজ বলে, ‘বেগুনের ভুঁইয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, সেখান থেকে দুজনই বাড়ি ফিরে আসি। তারপর কাওছার কোথায় গেছে তা তো জানি না। আমগাছে ওঠার কথা মিথ্যা।’ এ কথা শুনে কাওছার খানেকটা থেতোমেতো খেয়ে প্রতিবেদকের কাছে এসে বলে, ‘সত্যি বলতে কি জানেন, আমি নিজেই ওই গাছের উঁচুডালে উঠেছিলাম। উঠে নিচের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যাই। নামতে না পেরে সেখানে বসে পড়ি।’ তাহলে ওই মিথ্যা গল্প বলছো কেনো? পাশেই দাঁড়ানো মামার দিকে তাকিয়ে কাওছার থেমে গেলো। মামার ডাকে সাড়া দিয়ে দোকানে ফেরে সে। কিছুক্ষণ পরই সেখানে হাজির কথিত কবিরাজ জালাল উদ্দীন। বাড়ি ভাণ্ডারদহে। তিনি ও এক ইমামসহ স্বামী পরিত্যক্তা নারী এলাকায় জিন-পরী তাড়ানোর মনগড়া গল্প বলে শুরু করেছেন বাণিজ্য। এ তথ্য জানিয়ে স্থানীয় সচেতন যুবসমাজ বলেছে, ওই কাওছারের মামার পুত্রবধূসহ অনেকেই হিস্টোরিয়ায় আক্রান্ত। জিন তাড়ানোর অছিলায় ওই জালাল কবিরাজ আগে থেকেই কাওছারের মামাবাড়িতে আসা যাওয়া। সেই সুবাদে পরশু রাতে কাওছারকে চিকিৎসা দিতে মামা মীর মো. আরজেত আলীই ডাকেন কবিরাজকে। হাসপাতাল থেকে কাওছারকে মামাবাড়ি নেয়ার পর শুরু হয় জিন তাড়ানোর নামে বেত্রঘাত। চোখে দেয়া হয় ঝাঁঝালো তেল। নাকের সামনে ধরা হয় অজ্ঞাত পদার্থ। তাতে কাওছার কিছুক্ষণ সংজ্ঞাহীনও হয়ে পড়ে। এতো কিছুর পরও কাওছারের মুখ থেকে কবিরাজ তার পছন্দের উক্তি বের করাতে পারেনি। তবে সে অন্যের কাছে শোনা গল্পের সাথে মিল রেখে নিজের গাছে ওঠার মনগড়া গল্প বলেও শেষ পর্যন্ত নিজেই গাছে ওঠার কথা স্বীকার করেছে। স্থানীয়দের অনেকেই বলেছেন, কবিরাজ জালাল উদ্দীন জিন বোতলে ভরার নাটকই শুধু করেননি, তিনি বেত্রাঘাতে আহত করেন। হাতের একটি আঙুলে শুতুলি বেধে মটকে দেন। গতকাল দুপুরে যখন কাওছারের সাথে কথা হয়, তখন কবিরাজের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, হাতের আঙুলটা এখনও খুব ব্যথা।

কথিত কবিরাজ জালাল উদ্দীনকে কাছে পেয়ে তার কবিরাজি শিক্ষা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি তিনটি বই পড়েই জিন-পরী তাড়ানো শিখেছেন বলে জানালেন। মনগড়া গল্প বলতে বলতে তিনি একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির আলমারিতে রাখা বোতলে ৫১২টা জিন ভরা আছে’। বাব্বা, অতোগুলো জিন এক বোতলে থাকলে মারামারি করবে না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তোমরা যা ভাবছো তা নয়। ওদের তো দেখা যায় না। যেমন কওছারের ওপর দৃষ্টি দেয়া জিনকে পরশু রাতে ভরে দিলাম। ওটা দু বছরের মধ্যে ছাড়া পাচ্ছে না। আর কওছারকে তাবিজ দিয়েছি। আচি আর মওতোবাড়ি গেলে তাবিজের গুণ কেটে যাবে।’ ৫১২টা জিন কোথায় পেলেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাভারের গামের্ন্টেসে শ্রমিকরা কাজ করতে পারতো না। কাজ করতে গেলেই অজ্ঞান হয়ে যেতো। ৬ দিন বন্ধ থাকার পর আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যায়। আমরা তিনজন সেখানে গিয়ে জানতে পারি। যেখানে গামের্ন্টস সেখানে ভবন করার আগে একটি নারকেল ও একটি তালগাছ ছিলো। সেই গাছেই থাকতো জিন। তালগাছে ৫শ আর নারকেল গাছের ১২টা জিনই বন্দি করি বোতলে ভোরে নিয়ে আসি। সেই জিনগুলো এখনও রয়েছে বাড়ির আলমারিতে।’

একজন মানুষ মনগড়া কতোটা বানোয়াট গল্প বলতে পারে তা ৬০ বছর বয়সী জালাল উদ্দীনের কথা না শুনলে বোঝানো কঠিন। ৫১২টা জিনের একটি জিন বের করে দেখানো যাবে? আপনি যখন জিন ধরে বোতলে ভরতে পারেন তখন জিনকে দিয়ে অনেক কিছু তো করাতেও পারেন তাই না? আমাদের কিছু একটু করিয়ে দেখাতে পারবেন? জালাল কবিরাজ আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মোবাইলফোনে কথা বলেই উঠে পড়েন। বলেন, ‘জরুরি ডাক পড়েছে। ঝাড়তে যেতে হবে।’ কয়েক বছর আগেও তিনি আলমসাধু চালাতেন। এরপর তিনি কবিরাজ সেজে জিন বোতলে ভরার গল্প ফেঁদে পেতে বসেছেন প্রতারণার দোকান। হিস্টোরিয়া আক্রান্তদের চিকিৎসার নামে এলাকার সরলসোজা মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে হাতাচ্ছে টাকা।

উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার বড়গাংনী গ্রামের আবুল কাশেমের ৮ ছেলেমেয়ের মধ্যে কাওছার ছোট। সে তার মামা চুয়াডাঙ্গা ডিঙ্গেদহ মানিকদিহর মীর মো. আরজেত আলীর বাড়িতে থাকে। ডিঙ্গেদহ বাজারের দোকানে বসে। পরশু বিকেলে দোকানের অদূরবর্তী বাঁশ বাগানে থাকা একটি চটকা গাছের মগডালে উঠে এলাকাবাসীকে চমকে দেয়। তাকে নামিয়ে আনেতে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা সাহস না দেখালেও এলাকার কয়েক সাহসী পুরুষ গাছ থেকে রশি বেঁধে কিশোর কাওছারকে নামিয়ে আনেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসক বলেন, তেমন কিছুই নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। পরে তাকে তার মামাবাড়ি নিয়ে ওঝা ডেকে ঝাঁড়ফুঁকের নামে নাটক হয়। বিস্তারিত জানতে গেলে গতকাল উপরোক্ত তথ্য পাওয়া যায়।