ভক্তের আকস্মিক মৃত্যু : লাশ নিয়ে দীর্ঘ সময় চলে নাটক

ভক্তের আকস্মিক মৃত্যু : লাশ নিয়ে দীর্ঘ সময় চলে নাটক
স্টাফ রিপোর্টার: ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক দুপুর দেড়টা। একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস প্রবেশ করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন নেমে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে রোগী বহনের ট্রলি নিয়ে আসতেই আরো একটি শাদা মাইক্রোবাস থামে আগের ওই মাইক্রোবাসের পেছনে। সেটি থেকেই কয়েকজন তড়িঘড়ি মাইক্রোবাস থেকে নামেন। দু মাইক্রোবাসের যাত্রীরা মিলে একজন রোগীকে সেই ট্রলিতে তুলে নিয়ে যান জরুরি বিভাগে। হাসপাতালের কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার রাজীবুল ইসলাম ওই রোগীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু রোগীর সাথে থাকা লোকজন তাকে জীবিত বলে দাবি করেন। ডা. রাজীবুল ইসলাম আবারও রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করে মৃত বলেই ঘোষণা করেন। কিন্তু তবুও তা মানতে নারাজ রোগীর লোকজন। এ সময় ডা. রাজীবুল ইসলাম সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষকে সংবাদ দেন। তিনিও রোগীকে পরীক্ষার পর মৃত বলেই ঘোষণা দেন। রোগীর লোকজন তবুও দাবি করে বলেন, ‘বাবা বলেছে, সে মরেনি। চিকিৎসা দেন।’ কিন্তু তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে হাসপাতালে মৃত ব্যক্তিকে বাবার দোহাই দিয়ে বেঁচে থাকার দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে সেই বাবা তাকে বাঁচাতে পারেনি। পরে লাশ নিয়েই ফিরে গেছে বাবার অন্ধভক্তরা। বিষয়টি নিয়ে গোটা এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে এমনই এক রোগী ও তার সঙ্গীয় লোকজনের উল্টাপাল্টা কথার ঘোরটোপে বিপাকে পড়েন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের চোখে ধুলো দিয়ে সহজ-সরল মানুষকে কিভাবে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে তা ভেবে অস্থির ছিলেন চিকিৎসকরা।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা একাডেমি মোড়ে অবস্থিত মোহাম্মদী শপিং কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় বাবে নেয়ামত নামের একটি সাইনবোর্ড রয়েছে। সেখানে দেওয়ানবাগ দরবার শরিফ অনুসারীদের দ্বিবার্ষিক আশেকে রসুল (স.) নামীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সকালে ঢাকা থেকে ১৩টি মাইক্রোবাসযোগে প্রায় ১৩০ অনুসারীর একটি বহর নিয়ে সম্মেলনস্থলে পৌঁছান ঢাকাস্থ দেওয়ানবাগ দরবার শরিফের মহাসচিব সৈয়দ ড. এম সাইদুর রহমান আল মাহবুবী, (মা. আ.)। ওই বহরের অনুসারীদের মধ্যে ঢাকার বাসাবো সুবজবাগের ২০/৯ পূর্ব মাদারটেকের বাসিন্দা মোফাজ্জেল হোসেন (৫৫) তাদের সাথে ছিলেন। তিনি ঢাকার ২১/৫ মৌলভীটেক খিলগাঁও তালতলা মৃত সাজেমান মণ্ডলের ছেলে। সম্মেলনস্থলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার প্রস্তুতির সময় মোফাজ্জেল হোসেন হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। আর সেখানেই ঘটে বাবার অনুসারীদের অন্ধ বিশ্বাসের প্রতিফলন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসকরা জানান, ডা. রাজীবুল ইসলাম কয়েক দফা রোগীকে মৃত ঘোষণার পর রোগীর লোকজন তাকে জীবিত দাবি করায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডেকে নেন কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. পরিতোষ ঘোষকে। তিনি জরুরি বিভাগে পৌঁছে মোফাজ্জেল হোসেনের শারীরিক পরীক্ষা করে একই ফলাফল দেন। তবুও তারা রোগীকে জীবিত দাবি করায় ইসিজি করানো হয়। ইসিজি প্রতিবেদন দেখে তাতেও হার্টবিটের কোনো অস্তিত্ব না পাওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে চূড়ান্তভাবে মৃত ঘোষণা করেন। এরপরই ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ দুপুরে খাওয়ার জন্য বাসায় গেলে রোগীর লোকজনের অনুরোধে আবারও হাসপাতালে ফিরে আসেন। রোগী জীবিত রয়েছে এবং তাকে স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়ার দাবি করেন রোগীর সঙ্গীয় বাবার ভক্তরা। কিন্তু ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ সাফ জানিয়ে দেন মৃত মানুষের চিকিৎসা তার জানা নেই। কিন্তু নাছোড়বান্দা ভক্তরা দাবি করেন তাদের বাবা বলেছেন তিনি হাসপাতালে আসছেন। রোগী জীবিত রয়েছে। সে মরেনি। দুই ঘণ্টা ধরে এ পরিস্থিতি বিরাজ করায় বিরক্ত হয়ে পড়েন হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীসহ অন্য রোগী ও তাদের স্বজনরা। জরুরি বিভাগে মোফাজ্জেলের লাশ পড়ে থাকায় চরমভাবে ব্যাহত হয় চিকিৎসাসেবা।
এ পরিস্থিতির মধ্যে কে শোনে কার কথা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো যুক্তিই বাবার ভক্তদের কানে ঢুকছিলো না। উপস্থিত অনেকে তাদেরকে পাগল বলেও মন্তব্য করেন। অন্ধ ভক্তদের মন জুড়েই সেই কথিত বাবার প্রতি আস্থা ছিলো প্রবল। দীর্ঘ সময় ধরে জরুরি বিভাগে লাশ পড়ে থাকার পর চিকিৎসকদের নির্দেশে হাসপাতালের লোকজন তা নেয় লাশঘরে। সেখান থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কোনো বাবাই এলেন না হাসপাতলে। শেষ পর্যন্ত বাবা ভক্তদের অন্ধ বিশ্বাসে চিড় ধরে। তাদের ধারণা ও বাবার বুলি ভুল প্রমাণ করেই তারা লাশ নিয়ে ফিরে যান। গতকাল বিকেলেই অ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশ নিয়ে সকালের সেই গাড়ি বহরের সাথে তারা ঢাকায় ফিরে যান।
হাসপাতালে উপস্থিত বাবার অন্ধ ভক্তরা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মৃতের নাম পরিচয় গোপন করেন। পরে অবশ্য হাসপাতালের কাগজপত্র থেকে লাশের পরিচয় পাওয়া যায়। বাবা ভক্তদের কোনো নেতাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। চুয়াডাঙ্গা একাডেমি মোড়ে অবস্থিত বাবে নেয়ামতের ইমামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে গেছেন। কী কারণে এই এড়িয়ে যাওয়া সে প্রশ্ন এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোফাজ্জেল হোসেনের লাশ মৌলভীটেকে পিতার বাড়িতে পৌঁছেছে বলে জানা যায়।