বেহাল বেসরকারি চিকিত্সাসেবা

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে বেসরকারি চিকিত্সার নামে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। প্যাথলজি পরীক্ষার কোনো রেট নির্ধারণ করা নেই। যে হাসপাতাল যেমন পারছে তেমনি টাকা আদায় করছে। অপারেশনেরও নেই কোনো নির্দিষ্ট ফি। একই অপারেশনে, একেক হাসপাতালে একেক রকম ফি নিচ্ছে। পাশাপাশি অপারেশন থিয়েটারগুলোর অবস্থাও খুবই বেহাল। আর বহু বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে বিশ্বের কোন দেশই এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতও বাংলাদেশের কোন প্যাথলজির রিপোর্ট গ্রহণ করে না। ফলে দেশের বাইরে চিকিত্সা করাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অর্থের অপচয় হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘চিকিত্সার নামে এক শ্রেণির বেসরকারি হাসপাতাল অমানবিক কাজ করে, মৃত্যুর দিকে তারা রোগীদের ঠেলে দিচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আছে তাদের কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আমাদের এই অভিযান চলছে-চলবে। আইন অনুযায়িই ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত তিন মাসে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নামি-দামি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনষ্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়েছে। এমন ২০০টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১৯৫টিতেই অব্যবস্থাপনা পেয়েছে। প্রত্যেকটিকেই জেল-জরিমানা করেছেন আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট সারওয়ার আলম। ঢাকার নামি-দামি কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালসহ চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও ময়মনসিংহ শহরে অভিযান চালায় আদালত। এসব অভিযানে আদালত দেখেছেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ রি-এজেন্ট দিয়ে প্যাথলজি পরীক্ষা করা হচ্ছে। দেড়-দুই বছর আগেই যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ওই সব হাসপাতালে নিজেরাই হাতে লিখে মেয়াদ বাড়িয়েছে। অথচ এটি খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাথে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘অভিযানে আমরা দেখেছি, অপারেশন থিয়েটারে থাকা রাইসটিউব ও ক্যাথেটারও মেয়াদ উত্তীর্ণ। অপারেশনের ওষুধেরও তাই। যন্ত্রপাতিরও একই অবস্থা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ওই সব অপারেশন থিয়েটারগুলো নিজেরাই অস্বাস্থ্যকর। ঢাকার নামি-দামি হাসপাতালগুলোর ঢাকার বাইরেও শাখা আছে। সেখানেও পাওয়া গেছে একই চিত্র। চিকিত্সকের সই করা খালি রিপোর্টের কপিও তারা দেখেছেন। ওটি’র যন্ত্রপাতি ব্যবহার অনুপযোগী। অনেক হাসপাতালে তারা দেখেছেন, রোগীর রক্ত বা মল-মূত্র নেওয়ার পর সেটা বালতিতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর তাকে ইচ্ছেমতো একটি রিপোর্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, ‘এটা তো মৃত্যুর পরোয়ানার মতো। সম্প্রতি ঢাকার ফকিরাপুলে ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। যেখানে বিদেশগামীদের মেডিকেল চেকআপ করা হয়। টাকা দিলেই তারা ভালো বলে রিপোর্ট দেয়। আর টাকা না দিলেই ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না বলে রিপোর্ট দেয়। এছাড়া রাজধানীর একটি নামকরা হাসপাতাল মাথার খুলি রেখেই রোগীকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে গিয়ে এটি ধরা পড়ে। অথচ আলোচিত এই ঘটনার রোগী একজন সাংবাদিক। তার ক্ষেত্রে যখন এই অবস্থা, তখন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কি করা হয় তা সহজেই বোঝা যায় বলে সংশ্লিষ্ট একজন জানান।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এই অনিয়ম দেখার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের একটি ভিজিলেন্স টিম আছে। তারা কোথাও যান না। কিছুই দেখেন না। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের রাজধানীর নামি-দামি হাসপাতালে সব চিকিত্সাই ফ্রি। ফলে তারা এগুলো দেখেন না। জেলা-উপজেলায় এগুলো দেখার দায়িত্ব বিভাগীয় পরিচালক ও জেলায় সিভিল সার্জনদের। তারাও দেখেন না। অভিযোগ রয়েছে, তারা মাসোহারা পান। এই কারণে চোখের সামনেই এসব অনিয়ম দেখেও তারা চোখ বন্ধ রাখেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. সাইদুর রহমান বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কোন অনিয়ম পেলে শোকজ করতে পারি। তিনবার শোকজের পর লাইসেন্স বাতিল করতে পারি। কোন জেল-জরিমানা করতে পারি না। ফলে আমরা শোকজ করলেও কাজ হয় না। আবার র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতে গেলে বাধা দেয় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলো। সম্প্রতি রাজশাহীতে এই ধরনের অভিযানের পর বেসরকারি হাসপাতালগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে নামে। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, সারাদেশে তাদের সদস্য তিন হাজার। অথচ সারাদেশে ১০ হাজারের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার রয়েছে। ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া ইত্তেফাককে বলেন, ‘সরকারের পাশাপাশি আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। অঅনুমোদিতদের আমরা সমর্থন করি না। যেহেতু আমরা সেবা দেই, তাই সরকারকেও বলব বিষয়টা সহনশীল পর্যায়ে দেখতে। তবে যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু সবাইকে অভিযুক্ত করা যাবে না। অনেক হাসপাতালেই ভালো চিকিত্সা হচ্ছে, মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।