বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয়াবহ স্থবিরতা : ঋণের উচ্চ সুদে সব তছনছ

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয়াবহ স্থবিরতা নেমে এসেছে। সংকুচিত হয়ে পড়ছে কর্মসংস্থানের পথ। বিনিয়োগ না থাকায় নতুন কোনো শিল্প গড়ে উঠছে না। চলমান শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও সম্প্রসারিত হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ঋণের উচ্চ সুদের কারণে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আমদানিকৃত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়াত্বের মুখে পড়েছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর এই উচ্চ সুদের হারের কারণে সব তছনছ হয়ে পড়েছে। দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আজ হোক বা কাল ধ্বংস হয়ে যাবে। পাশাপাশি ঋণ ফেরত না পেয়ে ব্যাংকগুলোও দেউলিয়া হবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের পুরো অর্থনীতিতেই। এরই মাঝে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে (৯ শতাংশের মধ্যে) নামিয়ে আনার জোর দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, ঋণের সুদের হার না কমালে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদের হার কমাতে তাগাদা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ১৯টি ব্যাংককে শিল্প খাতে ঋণের সুদের হার কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ তোয়াক্কা না করে প্রতিটি ব্যাংক ঋণের বিপরীতে উচ্চহারে সুদ আদায় করছে। আমানতের বিপরীতে যেখানে সুদের হার ৮ থেকে ৯ শতাংশ, সেখানে ঋণের বিপরীতে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ সুদ আদায় করছে। শিল্পঋণে এই হার ২০ শতাংশের বেশি হওয়ার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সার্ভিস চার্জ ও কমিশন মিলে এই হার ২২ থেকে ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সরকারের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু একশ্রেণির পরামর্শদাতা সেগুলো ম্লান করে দিচ্ছে। তারা বিনিয়োগ ও ব্যাংক সুদের হারের বিষয়ে সরকারকে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। সব জেনে-শুনে কতিপয় পরামর্শদাতা সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এসব ষড়যন্ত্রকারী ঘাপটি মেরে বসে আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উদ্যোক্তা বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু তা শিল্পবান্ধব না হলে শিল্প চলবে না। এতে ব্যাংকের টাকাও পরিশোধ সম্ভব হবে না। ফলে একপর্যায়ে ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো তখন কিছুই করার থাকবে না। রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার আসার অবস্থায় পরিস্থিতি দাঁড়াবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি সর্বশেষ সুদের হিসাব প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত আগস্টে ব্যাংকগুলো শিল্পের জন্য মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারণ করে ১৮ শতাংশ। ক্ষুদ্র শিল্পের সুদের হার হচ্ছে ২৩.৭৫ শতাংশ। ব্যবসার ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার হচ্ছে ১৮.৫০ শতাংশ ও আবাসন খাতের সুদের হার ১৯ শতাংশ। এই উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বিনিয়োগ কমেছে ৫২ শতাংশ। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকে অলস পড়ে আছে ৮০ হাজার কোটি টাকা।

একজন উদ্যোক্তা আক্ষেপ করে বলেন, ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিলে বছরে ২০ কোটি টাকা সুদ গুনতে হচ্ছে। এজন্য অন্তত ৩০ শতাংশ মুনাফা করতে হবে। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব নয়। তার মতে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে বিরাজ করছে। ওইসব দেশের উৎপাদন খরচও কম।

অপরদিকে আমার পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। ফলে দেশীয় পণ্য আমদানিকৃত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এতে উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হয়ে খেলাপির তালিকায় যোগ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এক কোটি টাকা ব্যাংকে রেখে বছরে ১২ লাখ টাকা সুদ পেলে তারা বিনিয়োগে আসবে না। শেয়ারবাজারমুখী হবে না। ফলে বিনিয়োগও হবে না। আর বিনিয়োগ বন্ধ থাকলে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। এ বিষয়ে সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, সুদের উচ্চ হারের কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না- এই মতের সাথে রাস্তার শিশুও একমত হবে। আমিও এটির সাথে একমত পোষণ করছি। এ নিয়ে অনেক বলা হয়েছে। উচ্চ সুদে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বাধার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও বই লেখা হয়েছে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ব্যবসায়ীরা সুদের হার কমানোর দাবি করছে। আমরাও চাই সুদের হার যেন কমে। তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। সুদের হার ঠিক করছে ব্যাংকের বোর্ডগুলো। আগামীকাল থেকে সুদের হার কমাতে হবে- এ নির্দেশ দিতে পারবে না সরকার। তবে সরকার নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং কর কমিয়ে সুদের হার সহনীয় মাত্রায় আনার চেষ্টা করতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে।

ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমিয়ে আনার দাবি ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কয়েকটি ব্যাংক নিজেদের উদ্যোগে ঋণের সুদ হার সামান্য কমালেও সেটা তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ এগ্রিকালচার মেশিনারিজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম রাব্বানী চৌধুরী বলেন, আমানত ও ঋণের সুদের ব্যবধান ২ থেকে আড়াই শতাংশ রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিলেও ব্যাংকগুলো মানছে না। আমানতের সুদ আড়াই শতাংশ, ঋণের সুদ রাখছে ১৬ শতাংশ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ব্যাংকগুলোর মনোভাব যদি এমন হয় যে, তোমাকে ঋণ দিয়েছি, খেয়ে বাঁচবা। তোমাকে সুদের হার নিয়ে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে, তাহলে ব্যবসায়ীরা টিকবে কীভাবে?

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ঋণের উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগে কিছু বাধা সৃষ্টি করছে। সুদের হার না কমার জন্য দায়ী ব্যবসায়ীরা। কারণ ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোর বোর্ডে বসে আছেন। তারাই সুদের হার ঠিক করেন। বাইরে এসে তারা আবার সুদের হার কমানোর দাবি করেন। ব্যবসায়ীদের এই দু ধরনের চেহারার কারণে সুদের হার কমছে না। সুদের হার অসহনীয় মাত্রায় বিরাজ করায় তা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার আবেদন জানিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। তাতে জরুরিভিত্তিতে এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ ও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশের বিরাজমান ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবসহ কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ না হওয়ায় অর্থনীতি এক ক্রান্তিকাল সময় পার করছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নিরসন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বাড়ানো অতি জরুরি। এজন্য ব্যাংক সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করে দেশী শিল্প সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও রফতানি বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।