বিধ্বস্ত জনপদে প্রাণসঞ্চারে জোর তৎপরতা

 

স্টাফ রিপোর্টার: ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় সৃষ্ট মহাদুর্যোগে বিপর্যস্ত জনজীবন স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার প্রাণান্তকর প্রয়াস চলছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের শতাধিক পয়েন্ট বিধ্বস্ত হয়ে থাকার কারণে গতকাল শনিবার কাপ্তাই থেকে জনচলাচল ও পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। প্রতিদিন ২টি লঞ্চ দু’দফায় আসা-যাওয়া শুরু করেছে। এতে করে রাঙ্গামাটি শহরে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে তা কিছুটা লাঘব হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। শুক্রবার রাতে জেলার জুরাইছড়িতে দুই নারী পুরুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামসহ পাহাড়ের তিন জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুত, জ্বালানি, খাদ্যসহ বিভিন্ন সঙ্কট ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটছে। পণ্য সামগ্রীর মূল্যের যে উর্ধগামিতা সৃষ্টি হয়েছিলো তা হ্রাস পাচ্ছে। ভারি বর্ষণে ঢল ও পাহাড় ধসের ভয়াবহ ঘটনা রাঙ্গামাটি ট্র্যাজেডি হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নেবে। সিভিল প্রশাসন উদ্ধার তৎপরতা শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সমাপ্তি ঘোষণা করলেও সেনাবাহিনী উদ্ধারসহ সংস্কারের বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে মানিকছড়ি থেকে শহর এলাকা পর্যন্ত সড়ক সংস্কার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার কার্যক্রম সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শনিবার চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী ও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের চিফ মেজর জেনারেল সিদ্দিকুর রহমান রাঙ্গামাটির মানিকছড়ি, কাউখালী ও সদর এলাকার তিনটি দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম চলবে। ১৭টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি সেনাবাহিনী, ৪টি পুলিশ ও ৩টি বিজিবির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। এছাড়া সুপেয় পানির জন্য রাঙ্গামাটিতে একটি পানি শোধনাগার প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত থাকায় রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত ফলফলাদির স্তূপ পড়েছে এবং তা পচে গলে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে উৎপাদনকারীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানিকছড়ির সাপছড়ি এলাকায় সড়ক যোগাযোগ হালকা যানবাহনের জন্য আগামী চারদিনের মধ্যে এবং পনের দিনের মধ্যে ভারি যানবাহনের জন্য বিধ্বস্ত সড়ক সচল করা যাবে বলে জিওসি ঘোষণা দিয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসক উদ্ধার তৎপরতা আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করলেও সেনাবাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। তিনটি আশ্রয় কেন্দ্রে আজ রোববার থেকে দু’বেলা আশ্রিতদের খাদ্য সরবরাহ করা হবে। অপরদিকে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। তবে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে এমন আহত নর-নারী ও শিশুদের রাখা হয়েছে।

খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শনিবারও বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশ থেকে লোকজনকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। ভারি বর্ষণ হলে নতুন করে ভূমিধসের আশঙ্কায় প্রশাসন এ তৎপরতা প্রতিনিয়ত জোরদার করছে। অপরদিকে বান্দরবান জেলা প্রশাসনও বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসরতদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে।

রাঙ্গামাটি পরিস্থিতি

গত মঙ্গলবার ভারি বর্ষণ, ঝড়োহাওয়া ও ব্যাপকহারে পাহাড় বিধ্বস্তের ঘটনার পর শনিবার পর্যন্ত রাঙ্গামটির সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শুধু লঞ্চযোগে কাপ্তাই হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সীমিত আকারে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। এ দুর্যোগে শুধু রাঙ্গামাটি জেলায় লাশের সংখ্যা ১১২ জনে উন্নীত হয়েছে। উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ ঘোষণা করা হলেও শুক্রবার রাতে জুরাইছড়ির দুমদুমিয়া এলাকায় আরও দুটি লাশ মিলেছে। রাঙ্গামাটির বেদভেদি নতুন পাড়া এলাকায় এখনও ৮ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে এলাকাবাসী সূত্রে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি টিভি সেন্টার এলাকায় ২ জনের খোঁজ মিলছে না। এলাকার নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জানিয়েছেন এরা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উদ্ধার কাজ করেছে। রাঙ্গামাটির ভেদভেদীর নতুন পাড়ার বাসিন্দা আবদুল হাই জানান তার এলাকায় এখনও ৭/৮ জন ধ্বংসস্তূপে নিখোঁজ রয়েছে। টিভি সেন্টার এলাকার নুরুল ইসলাম জানান তার প্রতিবেশী ২ জনের লাশ এখনও মাটিতে চাপা পড়ে আছে। এসব নিখোঁজ লোকের আত্মীয় স্বজনেরা এলাকায় হন্য হয়ে লাশের সন্ধ্যান করছে। স্বজন হারাদের কান্নায় এখান সেখানের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আছে। প্রতিটা ধ্বংসস্তূপে এখনও শত শত মানুষ গিয়ে বিলাপ করছে।

রাঙ্গামাটি সেনা জোন শহরে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রিতদের চিকিৎসা সেবায় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে পুনর্বাসন করার জন্য সেনাবাহিনী, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন উদ্ধার তৎপরতা সমাপ্ত ঘোষণা করলেও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছে। তাদের সহায়তা করছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। রাঙ্গামাটির শহর এলাকাসহ ১০ উপজেলায় এমন কোন পাহাড় নেই যেখানে ছোট বড় এবং মাঝারি আকারের ধস সৃষ্টি হয়নি। আর এতে করে জানমাল ও সহায় সম্পদের ক্ষতি এত বেশি যে যার কারণে সর্বত্র মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। তবে দিন যতই গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি ঘটা শুরু হয়েছে।

রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইমদাত হোসেন জানিয়েছেন, রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের ৬১ কিলোমিটার এলাকায় ১৫০ ফুট সড়ক একেবারে ধসে গভীর খাদে পরিণত হয়েছে। এসব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সাথে সড়ক বিভাগও কাজ শুরু করেছে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে মহালছড়ি এলাকায় বিভিন্ন স্থানে ৭০ থেকে ৯০ ফুট পর্যন্ত সড়ক ধসে পড়ে একাকার হয়ে গেছে। এসব স্থানে জরুরী ভিত্তিতে বেইলি ব্রিজ স্থাপন ছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা যাবে না।

রাঙ্গামাটিতে জনজীবন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারি উদ্যোগে গৃহীত ব্যবস্থায় কাপ্তাই হয়ে জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চালান আসা শুরু হয়েছে। বাজারগুলোতে পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে গেলেও তা এখন হ্রাস পেতে শুরু করেছে। তবে এ জেলায় উৎপাদিত ফলফলাদিসহ অন্যান্য সামগ্রির বেহাল অবস্থা। আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, লিচুসহ বিভিন্ন ধরনের উৎপাদিত পণ্য ও মরসুমি ফল পচে গলে বিনষ্ট হয়ে গেছে। অপরদিকে সরকার ঘোষিত ত্রাণ সহায়তার অংশ পৌঁছেছে। পুরো রাঙ্গামাটি জেলায় ৩৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যার মধ্যে শুধু রাঙ্গামাটিতেই রয়েছে ১৭টি। জেলা প্রশাসন শনিবার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের কোন তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। পৌরসভার পক্ষ থেকে তালিকা প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে।

খাগড়াছড়ি পরিস্থিতি

মঙ্গলবারের প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাগড়াছড়িতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি এবং বড় ধরনের প্রাণহানি না ঘটলেও আগামীতে আবারও ভূমিধসের আশঙ্কায় শনিবার থেকে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে বসবাসরতের সরিয়ে নেয়া অব্যাহত রেখেছে। পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড় ধসের ঘটনার পর পর্যটকসহ বহিরাগতদের আসা যাওয়া শূন্যের কোটায় চলে গেছে। টানা বর্ষণের ঘটনায় জেলা সদরসহ নয় উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় দসের ঘটনা ঘটেছে। জেলায় পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে সহস্রাধিক পরিবার। সম্ভাব্য পাহাড় ধসের আরও ঘটনা ঘটতে পারে এ আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন সাধারণ মানুষকে সরে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাবার পরিবেশনের সময় অনেকে এ সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে আবার নিজ নিজ ঘরে চলে যাচ্ছেন। আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার জন্য জেলা প্রশাসন বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করেছে। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক রাশেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে থাকা লোকজন স্থায়ীভাবে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদে বসবাস করতে পারে সে লক্ষ্যে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি বিভিন্ন পাহাড়ে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। গেল সপ্তাহের মতো নতুন করে যদি ভারি বর্ষণ হয় খাগড়াছড়িতেও রাঙ্গামাটির ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বান্দরবান পরিস্থিতি: গত মঙ্গলবার পাহাড়জুড়ে ভূমিধসের ঘটনার পর এ জেলায়ও প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে। শনিবার শহরের কালাঘাটা, বড়ুয়ারটেক, পেন্সীঘোনা, রানীর চর, গজনিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে অভিযান পরিচারিত হয়। জেলা প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে, যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরে যাবে না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলার লামায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বৈঠক করেছে প্রশাসন। শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লামা পৌরসভা, ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন ও সদর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরতদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে।

কাপ্তাইয়ের পর রাঙ্গামাটিতেও নৌবাহিনী: রাঙ্গামাটিতে নৌবাহিনী ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা শুরু করেছে। কাপ্তাইয়ে চিকিৎসা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পর কাপ্তাইতেও নৌবাহিনীর পক্ষে ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি চিকিৎসা কার্যক্রমও শুরু হয়েছে শনিবার থেকে। রাঙ্গামাটিতে ব্যাপক ভূমিধসের ঘটনায় বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে আসায় সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সঙ্কট। ফলে সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে নৌবাহিনীও ত্রাণ সহায়তা ও চিকিৎসা প্রদানে যুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে কাপ্তাই এলাকার ব্যাঙছড়ি, ছিটমড়ল, ছিটছড়ি, বড়ইছড়ি চন্দ্রঘোণা ও রায়পুরা এলাকায় অনুরূপ কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে ৫শ’ পরিবারের মাঝে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে বলে নৌবাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে। খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে শুকনা খাবারই বেশি। এছাড়া চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, বিশুদ্ধ খাবার পানি, মোমবাতি, লবণ, শুকনো মরিচ, চিড়া, বিস্কুট, দিয়াশলাইসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য বিতরণ করা হচ্ছে।