বিদ্যুত আমদানি উদ্বোধন ও রামপালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যৌথভাবে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন উদ্বোধন ও রামপাল তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। গতকাল শনিবার তারা যৌথভাবে এ প্রকল্প দুটির উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরে অনুষ্ঠানস্থলে বক্তব্য রাখেন। পরে নয়াদিল্লি থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও ভারতবাসীকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান। তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে অনেকে চেঁচামেচি করছেন। তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতে চান, দেশের ক্ষতি হয় শেখ হাসিনাকে দিয়ে তেমন কোনো কাজ হবে না।

তিনি বলেন, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র চালু করেছেন। সেখানে কী ক্ষতি হয়েছে আজকে যারা চেঁচামেচি করছেন তারা তা বলতে পারছেন না। তার মানে সেখানে মানুষ ও পশুপাখির কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। রামপালেও কোনো ক্ষতি হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উতপাদনের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে বিগত সময়ে ৪ হাজার ৪৩২ মেগাওয়াট উতপাদন ক্ষমতার ৫৭টি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। ৩৩টি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ৩ হাজার ৯৭৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৯টি বিদ্যুতকেন্দ্র টেন্ডার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া ৩ হাজার ৫৪২ মেগাওয়াটের ৯টি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, তারা ইতোমধ্যে ১৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছেন। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মহেশখালী, মুন্সিগঞ্জ, বরগুনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করবেন। আগামীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে তাদের সাথে চীন, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার আলাপ-আলোচনা চলছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল, বাংলাদেশ-ভারত-ভুটান ত্রিপক্ষীয় বিদ্যুত চুক্তি ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুত আমদানি করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

এ সরকারের আমলে বিদ্যুত ব্যবস্থার উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তারা ৬২ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় নিয়ে এসেছেন। বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমিয়েছেন। ৯ হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন, ৩ লাখ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করেছেন। ২০ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন। মাত্র দু দিন আগে রূপপুরে ২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজ শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের কথাও তুলে ধরেন।
ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত-বাংলাদেশ পরস্পরের অকৃত্রিম বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী। এই বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের ফলে বন্ধুত্বের গভীরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে তারা একে অন্যের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আরো সামনে এগিয়ে যাবেন।

ভিডিও কনফারেন্সে মনমোহন সিং বলেন, জন্মগতভাবে বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু। দু দেশের সরকার ও জনগণ ভালো বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী। অংশীদারী উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে তারা অনেক দূর এগিয়েছেন। ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে যাবেন। ভিডিও কনফারেন্সে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। আগামীতে বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনায় অংশীদার হিসেবে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। মনমোহন সিং বাংলাদেশের এ উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তিনি বাংলাদেশের জনগণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এ প্রজেক্টে কর্মরত সব কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানেই বাংলাদেশ এ মাইলফলক অর্জন করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ সব সময়ই একে অপরের ভালো প্রতিবেশী। এর পাশাপাশি তাদের যৌথ উদ্যোগ অন্যান্য বিষয়েও তাদের সম্পর্কের অগ্রগতি ঘটিয়েছে। যৌথ সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সব সময় কাজ করবে বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশ উল্লেখ করে মনমোহন বলেন, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সফল দেখতে চায় ভারত। এটি অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় একটি দেশ। এ উদ্যোগ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নেও ভূমিকা পালন করবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের বিদ্যুত ও জ্বালানিবিষয়কমন্ত্রী আবদুল্লাহ ফারুক বলেন, সামনে দুর্গাপূজা আর ঈদ আসছে। উতসবের জন্য তিনি তাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব মানুষের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ সমপ্রীতি।

তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। আজকের এই অংশীদারী উন্নয়ন প্রকল্পের মতো ভবিষ্যতে আরো কাজ করব। দীর্ঘমেয়াদি এ বন্ধুত্ব তাদের অটুট থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানান।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, বিদ্যুত ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক, ভারতের জ্বালানি সচিব পিকে সিনহা, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিদ্যুত বিভাগের সচিব মনোয়ারুল হক। এ সময় তিনি বাংলাদেশের বিদ্যুত পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখান।

ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে পাবে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এর আগে ভারত থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত দেয়া শুরু হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর গতকাল শনিবার থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে ১৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত যোগ হয়। নভেম্বর নাগাদ ভারতের আরও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আসার কথা রয়েছে। এ বিদ্যুত আসবে ভারতের পাউয়ার ট্রেডিং কোম্পানির কাছ থেকে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পাবে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এর মধ্যে ২৫০ মেগাওয়াট দেবে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুত নিয়ন্ত্রক কমিশনের নির্ধারিত দামে। বাকি ২৫০ মেগাওয়াট বাংলাদেশকে কিনতে হবে ভারতের বিদ্যুতের বাজার থেকে বাজার দরে। বিপণনের ব্যবস্থা করবে ভারতের পাওয়ার ট্রেডিং কোম্পানি।

প্রসঙ্গত গত ২৭ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে ৫০ মেগাওয়াট সঞ্চালনের মধ্যদিয়ে ভারত থেকে প্রথমবারের মতো বিদ্যুত আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় ভারত বাংলাদেশের কাছে এ বিদ্যুত বিক্রি করছে। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি বিদ্যুত খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ওই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যুত সঞ্চালন কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ভারতীয় অংশে ৭৪ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশে ২৭ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতীয় অংশ নির্মাণ করে পাউয়ার গ্রিড কোম্পানি অব ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশ অংশ নির্মাণ করে পাউয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ। এ উপকেন্দ্রের মাধ্যমে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত ভারত থেকে আমদানি করা হবে। তবে উভয় দেশ চাইলে ভবিষ্যতে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করতে পারবে। এর মাধ্যমে ৪০০ কেভি হাইভোল্টেজ ডিরেক্ট কারেন্ট (এইচভিডিসি) গ্রিড উপকেন্দ্র এই প্রথম বাংলাদেশে নির্মিত হলো।