বিএনপিকে বাদ দিয়ে এখনও নির্বাচনের চেষ্টা চলছে

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। টানা ৬০ ঘণ্টা হরতালের প্রথম ১২ ঘণ্টা শেষ হওয়ার পর গতকাল রোববার বিকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। মির্জা ফখরুল বলেন, এখনও তারা (সরকার) যে চেষ্টা করছেন, সেটা হল বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন। কারণ তারা জানেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। তাই সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন করে নিয়েছেন যাতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারেন।

হরতালের প্রথম দিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি গণমাধ্যমকে জানাতে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল দাবি করেন, ২৫ অক্টোবর থেকে রোববার বিকাল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১২ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২৬শ নেতাকর্মী, গ্রেফতার হয়েছেন ১৫শ’র অধিক। বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫০ হাজার নেতাকর্মীকে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ১২ জন নেতাকর্মীকে ৬ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। এর মধ্যে হরতালের প্রথম দিনে নিহত হয়েছেন ৩ জন, আহত ১৫শ’, গ্রেফতার ৬শ’, বিভিন্ন মামলায় আসামি ১৫ হাজার।

হরতালের পক্ষে সারাদেশে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, গত পৌনে পাঁচ বছরে সরকার আমাদের কোনো স্কোপ দেয়নি। আমরা কেবল গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গেছি। আজ হরতালকে কেন্দ্র করে সারাদেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। ‘বিএনপির নেত্রী সমঝোতার পথ বন্ধ করে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছেন’- আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, তাদের এ বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন দেয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতারা যে ভাষায় কথা বলেছেন তা সংলাপের ভাষা নয়। তারা বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবকে রিজেক্ট করে দিয়েছেন। সংবিধানের বাইরে কিছুই হবে না বলে জানিয়েছেন। অথচ আমাদের আন্দোলনটাই হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। যেটা তারা সংবিধান থেকে মুছে দিয়েছে। ফখরুল বলেন, গত পাঁচ বছরে তাদের যে দুঃশাসন, দুর্নীতি ও জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন তাতে আগামী নির্বাচনে তাদের জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই তারা সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে একদিকে পুলিশ-ৱ্যাবকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর লেলিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে তাদের দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনীকেও ব্যবহার করছেন। কিন্তু এভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের এজেন্টরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন ও গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করতে হরতালের আগের দিন থেকে মন্ত্রী, বিচারপতির বাড়ি এবং ৱ্যাব-পুলিশের কার্যালয়ের সামনেসহ বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজি করছে। এসব দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের যানবাহনে হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দল ও জোটের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান ফখরুল।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহদফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, আসাদুল করীম শাহীন, নির্বাহী সদস্য বেলাল আহমেদ প্রমুখ।

এর আগে দুপুরে নয়াপল্টনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ফখরুল বলেন, হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। এটি সংলাপের জন্য কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমরা আশা করি, ১৮ দলীয় জোটের হরতাল শেষে সরকার সংলাপের উদ্যোগ নেবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার পর অথবা ৩০ তারিখ- যেকোনো দিন সংলাপ হতে পারে। শনিবার টেলিফোনে দু নেত্রীর কথোপকথন প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী গতকাল বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোন করেছেন, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আশাবাদী ২৯ তারিখের পর যেকোনো সময় যে কোনো স্থানে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংলাপ অনুষ্ঠানে সরকার উদ্যোগ নেবে।

ফখরুল দাবি করেন, সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একটানা এ হরতাল চলবে। হরতাল চলাকালে ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপির একজন কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। ভোরে হরতাল শুরুর আগেই নয়াপল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে এসে তৃতীয় তলায় নিজের চেম্বারে অবস্থান নেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল। সেখানেই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা সংলাপের জন্য দু দিন সময় বেঁধে দিয়ে এ হরতালের ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করলেও কেন হরতাল করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, সভা-সমাবেশের ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমাদের শর্তসাপেক্ষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করতে হয়েছে। সারাদেশে নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। সরকারের এহেন আচরণের প্রতিবাদ ও নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আমরা ৬০ ঘণ্টার এ হরতাল আহবান করেছি। আমরা মনে করি, সরকারের এহেন আচরণের মধ্যে সংলাপ সফল হতে পারে না। হরতাল কেন প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়- তার ব্যাখ্যায় বিএনপির মুখপাত্র বলেন, প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনের আগে বিরোধীদলীয় নেতা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আর যে সময় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন, তখন জোট নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিলো না। গণভবনে বিরোধীদলীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে সর্বদলীয় সরকারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আমাদের দাবি নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় সরকার নিয়ে। এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করতে চান, সর্বদলীয় সরকারের বিষয় নয়। এটা পরিষ্কার হতে হবে।

সংলাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করবেন কিনা জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, আমি ইতোমধ্যে তাকে চিঠি দিয়েছি। তার সঙ্গে টেলিফোনেও কথা হয়েছে। তাকে অনুরোধ জানিয়েছি, সংলাপ শুরু করতে। সামনে বিরোধী দলের আরও কর্মসূচি আসছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি নির্ভর করবে সরকারের পদক্ষেপের ওপর। ও লেভেল পরীক্ষার মধ্যে এভাবে তিন দিন ধরে হরতাল কতটা যৌক্তিক- এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়েই আমরা দীর্ঘদিন পর হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়েছি। শুক্রবার সারা দেশে আমাদের ৭ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। পরীক্ষার বিষয়টি দলের বিবেচনায় আছে। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজের জন্য ব্যবহৃত যানবাহন হরতালের বাইরে থাকবে বলে জানান তিনি।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ও করা হচ্ছে। সরকার একদিকে সংলাপের কথা বললেও অন্যদিকে তারা পুলিশ দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন করছে। এ থেকে সরকারের মনের ভাবনা বোঝা যায়।