বিএনপিকে আদালতে ব্যস্ত রাখতে চায় সরকার

স্টাফ রিপোর্টার: বিগত সময় প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিকে দমিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলেও এবার সে কৌশল বদল করেছে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে বিএনপিকে আইন-আদালতে ব্যস্ত রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। এতে নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণায় বেশি সময় ব্যয় করতে পারবেন বলে তাদের ধারণা।

সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে এ মুহূর্তে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না আওয়ামী লীগ। নেতাকর্মীদের নামে দায়ের হওয়া মামলা দিয়েই বিএনপির রশি টানতে চায় তারা। অতীতে বিএনপির কর্মসূচি বানচাল করতে সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হস্তক্ষেপ করলেও এবার নির্বাচন পর্যন্ত আইনি সহায়তায় তাদের নাজেহাল করে দমিয়ে রাখা হবে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত করা, ঘনঘন হাজিরার তারিখ দেয়া, কেন্দ্রীয় নেতাদের মামলায় রায় দিয়ে দলটিকে ব্যস্ত রাখতে চায় তারা।

পাশাপাশি ধীরস্থিরভাবে তারা যাতে কর্মসূচি পালন করতে না পারে সে জন্য প্রত্যেক এলাকায় নিয়মিত গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে সক্রিয় নেতাদের গ্রেফতার করা, দলটির কর্মসূচি-মিছিল-মিটিং, রাজপথের আন্দোলন সবকিছুই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকার।

জানা গেছে, বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে পালন করতে দেয়া হবে। পাশাপাশি তা যেনো বড় আকার ধারণ না করে এবং জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। আবার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথেও নামতে দেয়া হবে না দলটিকে। বিএনপি যদি সহিংস হয় তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমেই তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে এবং প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সব সময়ই মাঠে নামতে প্রস্তুত থাকবে। তবে আগ বাড়িয়ে নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়াবে না।

সূত্র আরও জানায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ভরসা করে বিএনপিকে একেবারে মাঠ ফাঁকা করে দেবে না আওয়ামী লীগ। দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি বিএনপি ছাড় না দেয়ার বার্তা পৌঁছানো হবে তৃণমূলে। বিএনপি-জাতীয় পার্টিকে নজরে রেখে কাউকেই মাঠে শক্ত অবস্থান করতে দেবে না ক্ষমতাসীনরা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে যেসব মামলা রয়েছে তা মোকাবেলা করতেই সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকবে দলটি। অনেক কেন্দ্রীয় নেতার নামে দায়েরকৃত মামলার কার্যক্রমও শেষদিকে। রায়ে সাজা হলে তাদেরও জেলে যেতে হবে। নেতারা অযোগ্য হলে নির্বাচনে অংশ নিতে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে দৌড়ঝাঁপ করেই তাদের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হবে। এছাড়া অনেকের নামে পরোয়ানা রয়েছে যাদের গ্রেফতার করতে খুঁজছে পুলিশ। ফলে এ দলটি মামলা ও আইন-আদালতের জাল থেকে বের হয়ে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবে না। তাই বিএনপিকে মোকাবেলায় আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক শক্তি ব্যয় করার প্রয়োজন হবে না।

তারা আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা যখন মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন তখন আন্দোলন করার কোনো চিন্তা তারা করবেন না। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে কোনো কাজেই তারা সফল হবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘বিএনপিকে আইনিভাবে শায়েস্তা করা হবে। তারা নির্বাচনে এলেও বেশিরভাগ নেতার নির্বাচন করার যোগ্যতা থাকবে না এবং আদালতে হাজিরা দিতে দিতেই সময় পার করবে। বিএনপির আন্দোলন সামাল দিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ব্যস্ত থাকতে হবে না।

বিএনপি ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিগত ওয়ান-ইলেভেন থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগের দুই আমলে সব মিলিয়ে সারাদেশে প্রায় ৫০ হাজার মামলা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। এসব মামলায় নামে ও বেনামে প্রায় ১২ লাখ আসামি রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজার ৫৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ ২৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে চলা আন্দোলনেও নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেয়া হয়।

এদিকে শুধু বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে জিয়া চেরিট্যাবল ট্রাস্ট, রাজধানীর দারুসসালাম থানার আটটি নাশকতার মামলা, যাত্রাবাড়ী থানার যাত্রী হত্যা মামলা, মানহানি মামলা দুটি, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা ও বড়পুকুড়িয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা, ড্যান্ডি ডাইং কোম্পানির ঋণখেলাপি মামলাসহ মোট ৩৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় তার ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিএনপি মামলার বোঝা নিয়ে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রচারের চেয়ে আদালতের বারান্দায় বেশি সময় ব্যয় করতে হবে। এটা সরকারের আরেকটি কূটকৌশল।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিএনপি যদি রাজপথে সহিংসতা করে তাহলে তাদের জন্য আইন রয়েছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া অতীতে যারা অপকর্ম করেছে, যাদের নামে মামলা রয়েছে সে বিষয়ে আইন মোতাবেক আদালত ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বা সরকার কোনো রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপিকে ব্যস্ত রাখেনি। বিএনপি তাদের অপকর্মের ফল ভোগ করছে।

আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, বিএনপির সঙ্গে পাল্টাপাল্টি করে আওয়ামী লীগ কোনো কর্মসূচি দেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোনো বাধাও দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, তারা যদি কোনো নাশকতা করে তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়ার রায়ের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি আদালতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, আদালত অবমাননা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। এখানে রাজনীতির কিছু নেই। আর যারা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে তো প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- এটাই স্বাভাবিক।

খালেদা জিয়ার মামলায় সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার আপিলের সুযোগ আছে। জামিন দেবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত। তার কারাবাস প্রলম্বিত হবে কিনা তা আদালতই ভালো জানেন। এ ব্যাপারে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না।