বাংলাদেশ-শ্রীলংকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে মতৈক্য -হাসিনা-সিরিসেনা বৈঠক ১৪ চুক্তি-সমঝোতা সই

স্টাফ রিপোর্টার: তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসা শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। প্রতিবেশী এই দুই দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ১৪টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সিরিসেনা গতকাল সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছুলে টাইগার গেটে তাকে স্বাগত জানান হাসিনা। ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেয়া হয় শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টকে। দুই নেতা প্রথমে একান্ত বৈঠকে অংশ নেন। তারপর দুই দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চামেলি হলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন। শেষে করবীতে দুই নেতার উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো সই হয়। এর মধ্যে দুই দেশের কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভিসাবিহীন চলাচলের বিষয়ে একটি চুক্তিতে সই করেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবী করুনানায়েকে। এছাড়া অর্থনৈতিক ও কৃষি খাতে সহযোগিতা, উচ্চশিক্ষা, বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে, পররাষ্ট্র সেবা বিষয়ক ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বিস’ ও শ্রীলংকার এলকেআইআইআরএসএসের মধ্যে এবং রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র, দুদেশের মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান, সংবাদ সংস্থা এবং চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ফ্যাশন ইনস্টিটিউট ও শ্রীলংকা টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল ইনস্টিটিউটের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে বাকি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হয়।

দুই পক্ষই আশা করছে, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের এই সফর পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করবে। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট তিন দিনের সফরে বৃহস্পতিবার ঢাকায় পৌঁছুলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এই সফরে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা থাকছেন ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে। তার সফর উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশে এটা তার প্রথম সফর হলেও এর আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা ঘুরে গেছেন মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। বৃহস্পতিবার ঢাকা পৌঁছানোর পর বিকালে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট। পরে তিনি ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। জাদুঘরে তাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুর নাতনি সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এই সফরে ৭৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের সাথে রয়েছে। শনিবার ঢাকা ছাড়ার আগে একটি বাণিজ্য সংলাপে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে তার।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি: এদিকে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে শ্রীলংকার সঙ্গে এ বছরই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানিয়েছেন, শ্রীলংকার সঙ্গে এফটিএ হলে এটাই হবে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো দেশের এ ধরনের প্রথম চুক্তি। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সঙ্গে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এফটিএ নিয়ে ঐকমত্য হয় বলে পররাষ্ট্র সচিব জানান। দুই নেতার বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব ও প্রধানমন্ত্রী প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। শহীদুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা চলতি বছরই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্য যে আলোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার তা দ্রুত শেষ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘এটা একটা অসম্ভব ব্রেক থ্রু। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে কারও এফটিএ নেই। যদি ২০১৭-তে এফটিএ হয়, তাহলে এটাই হবে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো দেশের প্রথম এফটিএ।’ ‘আমার মনে হয় এটা একটা বড় পলিটিক্যাল প্রসেস টুয়ার্ডস ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বিটুইন দ্য টু কান্ট্রিজ।’ বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলংকার বাণিজ্য বছরে আট কোটি ডলারের মতো। এ চুক্তি হলে দুদেশের বাণিজ্য আরও বাড়বে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র সচিব। ‘এটা বাড়ানোর জন্যই আমরা ২০১৩ থেকে আলোচনা করে আসছি, বলেন তিনি।

শহীদুল হক বলেন, দুই দেশের বাণিজ্যে এখন যেসব শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়েছে তা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে।
তাতে বাংলাদেশের কতটা লাভবান হবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, মিউচুয়ালি লাভবান হবে। বাট বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য এখন এক ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশকেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। শ্রীলংকার সঙ্গে প্রথমবারের মতো চুক্তি হলে বাংলাদেশে এ বিষয়ে যাচাইবাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দক্ষতা বাড়াতে পারবে বলে মনে করেন তিনি। ‘আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমরা এফটিএ আলোচনা করছি। সেইগুলো করতেও এটা সহায়তা করবে।’ পররাষ্ট্র সচিব বলেন, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের সফরকে কেন্দ্র করে শনিবারের মধ্যে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হবে। ৩৫ প্যারার এই যৌথ বিবৃতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতাও হয়ে গেছে। এই প্রথম বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার একটি যৌথে বিবৃতি আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক একটি কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) পাচ্ছে। ‘আগে যেটা ছিল যে, এই সম্পর্কটা ভাসা ভাসা থাকত। হয়তো কোনো সময় কিছু একটা ইমপ্লিমেন্টেশন হয়েছে, অনেকদিন পর আমরা ভুলে যেতাম কি হয়েছে। এই ১৪টা ইন্সট্রুমেন্ট ও জয়েন্ট স্টেইটমেন্টের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের একটা স্ট্রাকচার হলো।’
এই যৌথ ঘোষণায় দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার অঙ্গীকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্কের রূপরেখাও আরও স্পষ্ট হবে বলে পররাষ্ট্র সচিব জানান।