বাঁওড়ের দখল নিতেই জিয়াকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসী ওল্টু-টাকু গং

চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার কায়েতপাড়া বাঁওড়ের সভাপতি জিয়া হত্যার রহস্য উম্মচনে পুলিশ : মুনিয়ার ও ইউনুসের স্বীকারোক্তি

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড়ের সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে পুলিশ। বাঁওড়ের আধিপত্য হাতিয়ে নিতেই জিয়াকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে এলাকার চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ওল্টু-টাকু গং। গতকাল ২৭ এপ্রিল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদানকালে এ কথা বলেছে ধৃত আসামি বাঁওড়ের নৈশ্যপ্রহরী মুনিয়ার মণ্ডল ও ইউনুস আলী। বাঁওড়ের কতিপয় নৈশপ্রহরী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

পুলিশসূত্রে জানা গেছে, আলমডাঙ্গার রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড়ের সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া হত্যাকাণ্ডের ইতোমধ্যে সপ্তা অতিক্রান্ত হলো। এ মলার তদন্ত কর্মকর্তা বেশ কয়েকজনকে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পুলিশ এ পর্যন্ত বাঁওড়ের নৈশপ্রহরিদের মধ্যে সন্দেহভাজন সলোক, আব্দার, সেলিম, ইউনুস ও মুনিয়ারকে গ্রেফতার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করে। ইতোমধ্যেই পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের কারণ ও কাদের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সে সম্পর্কে মোটামুটি তথ্য সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। ইতঃপূর্বে গ্রেফতার করা বেশ কয়েকজন নৈশপ্রহরীর দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এরই এক পর্যায়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ধৃত নৈশপ্রহরী কায়েতপাড়া গ্রামের মৃত আনসার আলীর ছেলে ইউনুস আলী ও একই গ্রামের তাহাজ আলীর ছেলে মুনিয়ার মণ্ডলকে আদালতে উপস্থিত করা হলে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ১৬৪ ধারায় নিজেদেরকে বাঁচিয়ে জবানবন্দি প্রদান করেছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছে বাঁওড়ের আধিপত্য দখলের জন্যই জিয়াকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিয়রবিলা গ্রামের মৃত ঝড়ুর ছেলে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ওল্টু ও রামদিয়া গ্রামের আরেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী টাকু এবং টাকুর ভাস্তে সেলিম জিয়াকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করেছে। ওল্টু নিজে গুলি করে হত্যা করেছে। তবে ওই হত্যাকাণ্ডে জবানবন্দি প্রদানকারী দুজন জড়িত নয় বলে দাবি করে তারা জানিয়েছেন। তারা এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া দেখেছেন এবং হত্যাকারীদের চিনতে পেরেছেন।

নিহত জিয়া নৈশপ্রহরীদের সাথে বাঁওড়ের পানিতে নৌকায় রাত কাটাতো। প্রতি ভোরে তিনি মসজিদের নিকটে কূলে নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙায় নামতেন। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে তারপর বাড়িতে ঢুকতেন। কিন্তু শুরু হত্যাকাণ্ডের ভোরে তিনি মসজিদের নিকট না নেমে কিছুটা দূরে আলপথে নামেন। যেখানে তাকে খুন করা হয়। কেন শুধু ওই ভোরেই এ ব্যত্যয় ঘটলো? কোন কোন নৈশপ্রহরী তাকে প্ররোচিত করে ওই আল পথে যেখানে ঘাতকরা ওঁত পেতে ছিলো সেখানে নামিয়ে দিয়েছিলো? এমন প্রশ্নের উত্তরও পুলিশ পেয়ে গেছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।

আদালতে জবানবন্দিকালে দুই নৈশপ্রহরী জানিয়েছেন, ঘটনার রাতে নৈশপ্রহরী সলোক ও আব্দার জিয়াকে প্ররোচিত করে ঘাতকদের সামনে নিয়ে যায়।

এলাকাসূত্রে জানা যায়, আগের টার্মের বাঁওড় লিজ গ্রহীতা পক্ষের নেতা ওল্টু, টাকু ও তার ভাস্তে সেলিম গং নিহত জিয়ার নিকট আবারও ৩ বছরের জন্য বাঁওড়ের অধিকার চেয়েছিলেন। জিয়ার সমিতি তাতে রাজি না হওয়ায় জিয়ার সমিতিকে প্রথমে ৬ লাখ ও পরে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ নিয়ে চলছিলো দ্বন্দ্ব। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন খুনের হুমকিও দেয়া দিয়েছিলো। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পূর্বদিন বিকেলে নিহত জিয়ার ভাই আশা মাছ আনতে যায় রামদিয়ায়। সে সময় রামদিয়া বাজারে আশার সাথে তিয়রবিলার ওল্টুর ভাই লাল্টু, রামদিয়ার সন্ত্রাসী টাকু ও টাকুর ভাস্তে সেলিমের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তারা আশাকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘তোর ভাই জিয়ার আজই শেষ দিন।’

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিয়রবিলার ওল্টু হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ঠকপাড়ার হানেফ আলীর সাথে চরমপন্থি গ্রুপ করতো। তারা দুজনেই প্রায় দেড় যুগ জেল খেটে বাড়ি ফেরেন। টাকু প্রায় এক যুগ আগে রমজান মাসে তারাবি নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হলে প্রতিপক্ষ ৩ জনকে গুলি করে গুরুতর আহত করেন। সে মামলায় বহু বছর জেল খেটে সেও বর্তমানে বাড়িতে। এলাকাবাসীর ধারণা এ দুজনের নেতৃত্বে নতুন চরমপন্থি গ্যাং গ্রুপ তৈরি হয়েছে। টাকুর ভাস্তে ইদ্রিস আলীর ছেলে সেলিম এবং ওল্টুর ভাই লাল্টুও এ চরমপন্থি গ্রুপের নেতা। হত্যাকাণ্ডের প্রথম থেকেই এলাকাবাসীর সন্দেহ ছিলো নৈশপ্রহরীদের কয়েকজনের সহযোগিতায় এই চরমপন্থি গ্রুপই জিয়াকে হত্যা করতে পারে।

উল্লেখ্য, আলমডাঙ্গার কায়েতপাড়া গ্রামের মৃত আবুল মণ্ডলের ছোট ছেলে জিয়াউর রহমান জিয়া ছিলেন রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড় (বড় বিল) মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি। গত ১৯ এপ্রিল ভোরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাকে বাঁওড়ের কিনারে গুলি করে হত্যা করে। রাতে জিয়াউর রহমান জিয়া বাঁওড়ের নৌকায় ছিলেন। ভোর ৪টার দিকে নামাজ পড়ার উদ্দেশে নৌকা থেকে নেমে নিকটেই অবস্থিত নিজ বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সে সময় ওঁত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে উদ্দেশ্য করে গুলি চালায়। এ সময় মাথায় ও কোমরে গুলি বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।