ফাহিমের কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন

 

স্টাফ রিপোর্টার: সাড়ে তিন বছরে ৪৫৬ জন নিহত, সব বন্দুকযুদ্ধের গল্প একই রকম এখন পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনাতেও প্রতিপক্ষের কাউকে আটক করতে দেখা যায়নি। দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়নি। মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহরীরের সদস্য গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম (১৮) পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। সচেতন সমাজ বন্দুকযুদ্ধের এই দাবি মানতে নারাজ। তারা এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। মন্তব্যকারীদের কেউই পুলিশের গল্প বিশ্বাস করতে পারছেন না। তারা কথিত এই বন্দুকযুদ্ধকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন।

গত সাড়ে তিন বছরে কথিত বন্দুকযুদ্ধ/ক্রসফায়ার এবং পুলিশের হেফাজতে ৪৫৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৮৩ জন এবং চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৭৩ জন বন্দুকযুদ্ধে বা পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছেন। সব বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের গল্প ছিলো একইরকম। পুলিশের গল্প বা দাবি সত্য বলে ধরে নিলে তাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিবে। কেননা এতোগুলো হত্যাকাণ্ডের পরও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে তাদের দেখা যায়নি। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর এই ঘটনাকে খুব হালকাভাবে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনাতেও প্রতিপক্ষের কাউকে আটক করতেও দেখা যায়নি। দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়নি। ঘটনায় একজনই ক্ষতিগ্রস্ত হন (নিহত) যিনি ছিলেন শুধু পুলিশের হাতে আটক। ফলে ফাহিমের কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল এক অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সভাপতি সুলতানা কামাল বলেছেন, মানুষ আমাদের বলছে, যাদের ক্রসফায়ারে দেয়া হচ্ছে, তারা অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। অতএব তাদের মানবাধিকার নেই। এই যে একটা বোধ সমাজে চলে আসে, যেনতেনভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। এটা কোনো আধুনিক, গণতান্ত্রিক, সুশাসনসম্পন্ন রাষ্ট্রের লক্ষ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘হতাশা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্র নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না’।

মাদারীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল শনিবার ভোরে জেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিয়ারচর এলাকায় এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ দাবি করেছে। এসময় ফাহিমের হাতে পুলিশের হ্যান্ডকাফ ছিলো। ওই অবস্থায় ফাহিম কিভাবে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল-তা নিয়ে পুলিশ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তার বুকের বাম পাশে গুলির চিহ্ন রয়েছে। নিহত ফাহিম ঢাকার উত্তরা হাইস্কুল এন্ড কলেজ থেকে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্য ছিলেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ফাহিম ১০ দিনের পুলিশি রিমান্ডে ছিলেন। রিমান্ডের আসামি বন্দুকযুদ্ধে নিহতের  ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও পুলিশ দাবি করেছে, রিমান্ডের প্রথম দিনেই ফাহিমের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ঐ তথ্যের ভিত্তিতে তার সহকর্মীদের আটক করার অভিযানের সময় এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে।

শনিবার দুপুরে মাদারীপুরে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন জানান, ফাহিমের দেয়া তথ্য মতে ভোরে পুলিশ সদর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিয়ারচর এলাকায় যায়। এ সময় ফাহিমের পরিচিত হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার লক্ষ্যে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। ফাহিমের ‘সহযোগীদের গুলিতে’ পুলিশের গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় ফাহিম গুলিবিদ্ধ হলে পুলিশ তাকে চিকিত্সার জন্য সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিত্সক ফাহিমকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। গুলি বিনিময়ের সময় কনস্টেবল মো. আলী হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি আগ্নেয়াস্ত্র, রাইফেল ও বন্দুকের ৫টি গুলির খোসা ও ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।  ময়না তদন্ত শেষে পরিবার লাশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিয়ে যায়।

এদিকে, মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি জিয়াউল মোরশেদ জানান, জিজ্ঞাসাবাদে ফাহিম জানিয়েছেন, বরিশালে এক আইনজীবীর চেম্বারে তারা ৬ জন দেখা করেন। ফাহিম ছাড়া অন্যরা হলেন, সালমান তাসকিন, শাহরিয়ার হাসান, জাহিন, রায়হান ও মেজবাহ। ফাহিম উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হন। ওই কলেজের সামনে এক লাইব্রেরিতে প্রায়ই তারা বৈঠক করতেন। বরিশালে ওই আইনজীবীর চেম্বারে মাদারীপুরের সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ছবি দেখানো হয়। এরপরই তারা সিদ্ধান্ত নেন ছবির ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করতে হবে।

ফাহিমের দেওয়া তথ্য থেকে মাদারীপুর পুলিশ সন্দেহভাজন দুইজনকে আটক করেছে। তবে এ আটকের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে কলেজ এলাকায় ভাড়া করা বাসায় তিন যুবক কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। এ সময় জনতা ফাহিমকে আটক করতে পারলেও বাকি দুইজন পালিয়ে যায়। ফাহিমের বাড়ি ঢাকার দক্ষিণখানের ফায়দাবাদে। ৱ্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে.কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, ফাহিম হিযবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সংগঠনটির লিফলেট বিতরণের সময় একবার র্যাবের হাতে ধরা পড়ে জেলে যান। জামিনে মুক্তি পেয়ে মাদারীপুরে কিলিং মিশনে যোগ দেন। তাদের পরবর্তী টার্গেট ছিল বরিশাল শহরে।

গতকাল ফাহিমের পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফাহিমের নিহত হওয়ার খবর পৌঁছার পর তার বাবা-মা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের সন্তান যদি জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকে-তার বিচার চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে বন্দুকযুদ্ধের মতো নাটক সাজিয়ে হত্যা করতে হবে। এখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে কেউ যেন গণমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য না করে।

ফেসবুকে ঝড়: পুলিশের রিমান্ডে থাকা আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার খবর প্রকাশের পর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বেশিরভাগ পোস্টে সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, হয় ফাহিম এমন কিছু জানতেন যা তার জানা উচিত ছিল না, না হয় তিনি কিছুই জানতেন না। সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তার হাত পেছন থেকে হ্যান্ডকাফে বাধা ছিলো, তা নিয়েও। নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী তার ফেসবুক স্টাটাসে লিখেছেন, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের যখন সুরাহা করা যাচ্ছিল না, তখন ফাহিম গ্রেফতার হওয়ায় বেশকিছু তথ্য পাওয়া যাবে এমন আশা ছিলো দেশবাসীর। তিনি লিখেছেন, যেখানে এই আক্রমণের হাত থেকে আস্তিক নাস্তিক, হিন্দু, মুসলমান, নারী পুরুষ, সিভিলিয়ান পুলিশ কেউই ছাড় পাচ্ছিলো না, যেখানে এটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেছিলো এবং আমরা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের আলামত দেখছিলাম না, সেখানে মাদারীপুরের মানুষ এক আসামি হাতেনাতে ধরে ফেলার পর আশা করছিলাম, ভেতরের কলকাঠির সুলুক সন্ধান করা হবে। সেই স্থলে এই বন্দুকযুদ্ধের কী মানে?

অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ফজলুল বারী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাদের ভালো ইচ্ছাগুলোকে করে দেয়া হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ! মাদারীপুরে ধরা ফাহিম ছেলেটির রিপোর্টে পড়ছিলাম আদালতে বিচারককে সে চিত্কার করে বলে এই ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত না। স্থানীয় এক নেতা তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত কোনও জঙ্গি এভাবে কোর্টে বলে না। কিন্তু পুলিশ তাকে মেরে ফেললো ক্রসফায়ারে? স্থানীয় যে নেতার কথা ফাহিম বলেছিল, সে কি পুলিশের জন্য বিব্রতকর ছিল? আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী বারীর ওয়ালে লিখেছেন, ‘ফাইজুল্লাহ ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার কারণ দুটি হতে পারে। ১. সে অনেক তথ্য জানতো। ২. সে কিছুই জানতো না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ লিখেছেন ফেসবুকে, ‘এই আশঙ্কটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই সুতরাং নানা কাহিনি চালিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম, কিন্তু গোল বাধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে। পুরোটা না পারলেও ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই। যারা ফাহিমের মতো কিশোর তরুণদের গুম করে এসব অপারেশনে যেতে বাধ্য করে, তাদের পক্ষে এ রকম অবস্থায় বসে থাকলে চলে না। এই রকম বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট থাকার পরও ছেলেটা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হইছে। পুলিশ বলতেছে, ‘তার বুকের বামপাশে দুটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।’ সাব্বির জনি নামে একজন লিখেছেন, ‘পুলিশই তাকে গুলি করে খুন করেছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট তার দেয়া স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে পড়বে চলমান গুপ্তহত্যার সাথে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত’। ওবায়দুর রহমান লিখেছেন, ফাহিম বেঁচে থাকলে কার লস হত সেটা নিশ্চয়ই জনতা ভেবে দেখবে। আমাদের হাত বাঁধা চোখ বাঁধা কিন্তু আমরা উপলব্ধি করতে পারছি অনেক বড় ঝুঁকিতে আছে প্রিয় মাতৃভূমি’। নানা জনের এরকম মন্তব্যে ভরে উঠেছে ফেসবুকের পাতা। সর্বত্রই সমালোচনার ঝড়।