ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলো ভারত : কুষ্টিয়ার ৩০ গ্রাম প্লাবিত

 

পদ্মায় দৈনিক ১২-১৩ সেন্টিমিটার পানি বাড়ছে : ভরা নদীতে ১১ লাখ কিউসেক পানি সঙ্কট বাড়াবে

স্টাফ রিপোর্টার: ভারত ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেইট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশে পদ্মা বিধৌত এলাকায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পদ্মার পানির সমতল। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে পদ্মার পানির উচ্চতা প্রতিদিন প্রায় ১২ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চলতি সপ্তাহেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়াসহ পদ্মাপাড়ের বিশাল এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে বেড়ে যাওয়া পানিতে কুষ্টিয়ার ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আর আগামী সপ্তাহে বন্যার পানিতে প্লাবিত হতে পারে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ভোলাসহ মেঘনাপাড়ের জেলাগুলো।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ ছয় ঘণ্টায় পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও পাংখা পয়েন্টে যথাক্রমে ৪ ও ২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। এই গতিতে পানি বাড়তে থাকলে আজ শনিবার রাত বা আগামীকাল রোববার সকাল ৯টা নাগাদ নদীটির বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে।

পাউবোর একটি সূত্র জানায়, বিহারে বন্যার কারণে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেইটের সবকটিই খুলে দিয়েছে ভারত। তবে অপর একটি সূত্র জানায়, ৯৯ কিংবা ১০১টি গেইট খুঁলে দেয়া হয়েছে। হিমালয় থেকে উত্পন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা নামে। গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের আগে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় ভারতের ফারাক্কা বাঁধ। বর্ষা মরসুমে এ বাঁধ খুলে দেয়ায় বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়।

এবার গেইটগুলো খুলে দেয়ায় গঙ্গা থেকে ১১ লাখ কিউসেক পানি পদ্মায় নামছে। আর এ কারণেই পদ্মায় দ্রুত পানি বাড়ছে। গতকাল বেলা ৩টায় পদ্মার পাংখা, রাজশাহী ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার যথাক্রমে ১৫, ২০ ও ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। ইতোমধ্যে পদ্মার শাখা নদী গড়াইয়ের কামারখালী পয়েন্টে বিপদসীমার প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে মাগুরা সদরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। যশোরের ঝিকরগাছা পয়েন্টেও বিপদসীমার এক মিটারের বেশি উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মীর মোশাররফ হোসেন জানান, যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে শনিবার রাতে বা রোববার সকালে পদ্মায় বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারে।

পানি বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতির তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. মুনসুর রহমান বলেন, পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলো এখন অনেকটাই ভরাট। এর মধ্যে ১১ লাখ কিউসেক পানি এ নদী হয়েই যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে তবে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে পানি কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং ভারি বৃষ্টিপাত না হলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গঙ্গা-পদ্মায় পানি বৃদ্ধির প্রবণতা আরো অন্তত দুই-তিন দিন অব্যাহত থাকবে। ১১ লাখ কিউসেক পানি নতুন করে আমাদের নদীতে আসলেও তেমন সমস্যা হবে না। সার্বিক পরিস্থিতি বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করছে। তবে উজানে বৃষ্টিপাতের শঙ্কা কম থাকায় এখনই বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। এদিকে ভারি বৃষ্টিপাত না হলেও নতুন পানির কারণে পদ্মার পর মেঘনাপাড়ের জেলাগুলোতে বন্যা দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ভাটির দিকে ২৫৮ কিলোমিটার এগিয়ে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে এসে যমুনার সাথে পদ্মা মিলিত হয়েছে। সেই মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে আরো ১২০ কিলোমিটার এগিয়ে চাঁদপুরে এসে মেঘনার সাথে মিলেছে। পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নামে পৌঁছেছে বঙ্গোপসাগরে। তাই এ বিপুল পরিমাণ পানি বাংলাদেশ ছেড়ে নেমে যাওয়ার সময় মেঘনা পাড়ের চাঁদপুর, ভোলাসহ বিভিন্ন জেলা।

আমাদের রাজশাহী অফিস জানায়, পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী মহানগরীর কয়েকটি এলাকায় পদ্মার তীর রক্ষা প্রকল্প ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে বুলনপুর এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের নিচে পদ্মার তীর রক্ষা প্রকল্পের চারটি স্থান কিছুটা দেবে গেছে। বাঁধের ভেতরে নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বেশ কিছু ঘর বাড়িতেও পানি উঠেছে। পাউবোর কর্মকর্তা বলেন, বুলনপুর পুলিশ লাইনসের সামনে তীর রক্ষা প্রকল্পে ধস নামলে শহর রক্ষা বাঁধে প্রভাব পড়তে পারে। আপাতত পাথর ফেলে ধস ঠেকানোর চেষ্টা হয়েছে। উপরের মাটি  সরে যাওয়া রোধ করতে বালির বস্তাও ফেলা হয়েছে।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ভারত নিয়ন্ত্রিত ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেয়ায় আকস্মিকভাবে পদ্মা নদীর পানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পদ্মার নদীর পানি মারাত্নক বেড়ে যাওয়ায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে বিপদসীমার কাছাকাছি নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া পদ্মার পানি বৃদ্ধির কারণে ভারত সীমান্ত ঘেষাঁ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী চিলমারি ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের নীচু এলাকার ২০/২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে ওই দুটি ইউনিয়নের হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতি তিন ঘন্টায় দুই সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। যে গতিতে পানি বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের বিহার রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে ভারত নিয়ন্ত্রিত ফারাক্কা বাঁধের ১১৭টি গেটের মধ্যে ৯৯টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। এতে উজান থেকে নেমে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমায় প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া প্রতি তিন ঘন্টায় ২ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পদ্মা নদীতে পানির বিপদসীমা হচ্ছে ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। শুক্রবার দুপুর ১২ টায় পানি প্রবাহিত হয়েছে ১৪ দশমিক ০৬ সেন্টিমিটার। বিপদসীমা থেকে মাত্র পয়েন্ট ১৯ সেন্টিমিটার দূরে। গত ১৮ আগস্ট এ পানির মাত্রা ছিলো ১৩ দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার। ১৯ আগস্ট ছিল ১৩ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। ২৫ আগস্ট ছিল ১৩ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার। প্রতি তিন ঘন্টায় ২ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। পদ্মার পানি বাড়ার সাথে সাথে প্রধান শাখা গড়াই নদীতেও পানি বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নৈমূল হক জানান, ভারতের বিহার রাজ্যে প্রবল বৃষ্টিপাতসহ সেখানকার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভারত থেকে ফারাক্কা বাধের গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে পদ্মায় হঠাত্ দ্রুতগতিতে পানি বেড়ে যাচ্ছে। নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে যেকোনো মুহূর্তে পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেন। এদিকে হঠাত্ করে পদ্মায় পানি বাড়ায় জেলার দৌলতপুর উপজেলা চিলমারি ও রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের নীচু এলাকার ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে চর দুর্ভোগে পড়েছে। ওই এলাকার প্রতিটি ঘরেই পানি ঢুকে পড়েছে। কৃষকদের ঘরে মজুদকৃত পাট, ধান মরিচসহ খাদ্য-শষ্য পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব এলাকায় তীব্র খাবার পানি সংকটও দেখা দিয়েছে।

দৌলতদিয়া উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ জানান, গত কয়েক দিন ধরে অব্যাহতভাবে পদ্মা নদীর পানি বাড়ায় চিলমারির ১৮ গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ১২ গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। সেখানকার  প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে বলেও তিনি জানান। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ তেমন কোনো তত্পরতা লক্ষ্য করা যায়নি।