ফলোআপ: হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে অ্যাসিড বাহারি বেলুন : মারাত্মক অঘটনের আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টা: পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের এক সপ্তা পার হয়ে গেলেও চুয়াডাঙ্গা ও আশপাশ এলাকায় হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা বিশাল আকৃতির রঙিন বেলুন বিক্রি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ এখনও চোখে পড়েনি। বরং এ বেলুনের বেচাকেনা বেড়েছে দ্বিগুন হারে। দৈনিক মাথাভাঙ্গার অনুসন্ধানে বেলুন তৈরি ও এর ভেতরে যে হাইড্রোজেন গ্যাস ভরে ফুলানো হচ্ছে সে সম্পর্কে বেরিয়ে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। বিস্ফোরক শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হলো কারণ, হাইড্রোজন গ্যাস ভর্তি এসব বাহারি বেলুন আসলেই হতে পারে প্রাণঘাতি বিস্ফোরক। ঝলসে যেতে পারে যে কোনো মানুষের মুখমণ্ডলসহ সারা শরীর। আর এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে শিশুদের।

গ্যাস তৈরীর প্রণালী ও দুর্ঘটনার ভয়াবহতা: চুয়াডাঙ্গা শহরের ফার্মপাড়ার দুটি বাড়ি ও দামুড়হুদা উপজেলার কয়েকটি স্থানে গোপনে তৈরি হচ্ছে এই বেলুন ফুলানো হাইড্রোজেন গ্যাস। হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে সালফিউরিক অথবা হাইড্রোক্লোরিক আ্যসিড। আ্যসিডের সাথে মেশানো হচ্ছে জিংক। রাসায়নিক বিক্রিয়া শেষে উপজাত হিসেবে তৈরি হচ্ছে হাইড্রোজেন গ্যাস। তলানি হিসেবে জমছে জিংক সালফেট অথবা জিংক ক্লোরাইড লবণ । হাইড্রোজেন গ্যাস বাতাসের চেয়ে হালকা হওয়ায় বেলুন সহজেই উড়তে পারে। বেলুন উড়াতে সাধারণত ব্যবহার করা হতো হিলিয়াম গ্যাস। কিন্তু বর্তমানে এ গ্যাস অপেক্ষাকৃত বেশি দাম ও সহজলভ্য না হওয়ায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী হয়তো না বুঝেই মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এসিডের সাথে জিংক এর মিশ্রন ঘটিয়ে তৈরি করছেন হাইড্রোজেন গ্যাস। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চুয়াডাঙ্গার একটি প্রতিষ্ঠানের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক উপরোক্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ার তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, হাইড্রোজেন গ্যাস অতি দাহ্য বা সহজেই জ্বলে ওঠে। আচমকা কোনো বেলুন ফেটে গেলে পাশে ধূমপানরত কোনো ব্যক্তির সিগারেটের আগুনই যথেষ্ট। এ থেকেই ঘটতে পারে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড। অনেকটা পেট্রোল বোমার মতো। যতক্ষণ গ্যাস থাকবে ততক্ষণ আগুন স্থায়ী হবে। বেলুনগুলো প্লাস্টিক ও জরি কাগজ দিয়ে তৈরি মনে হলেও এগুলো আসলে পলিথিনেরই আরেকটি সংস্ককরণ। যা কোনোভাবেই পচনশীল নয়। দেশে এ ধরণের পলিথিনের ব্যবহার সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও সম্প্রতি চীন থেকে প্লাস্টিকের আদলে তৈরি এসব পণ্য দেদারছে দেশে আনা হচ্ছে বিভিন্ন কৌশলে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও গড়ে উঠেছে বেলুন কারখানা। গত কয়েকদিনে চুয়াডাঙ্গায় গ্যাস ভরা ঢাউস বেলুন ফেটে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

চুয়াডাঙ্গার শহীদ হাসান চত্বরে বিপদজনক পরিবেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি হাইড্রোজেন ভর্তি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে একের পর এক বেলুন ফোলানো চলছে। ডোরেমন, ঈগল, ডলফিন ও হাঙ্গরের আদলে তৈরি পলিথিনের রঙিন বেলুনগুলো দেখে সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে শিশুরা। বাবা-মা তার সন্তানের বায়না পুরণ করতে এক সাথে দু তিনটি কিনেও দিচ্ছেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না টাকা দিয়ে তারা যা কিনলেন তা তাদের আদরের সন্তানকে কতখানি বিপদে ফেলতে পারে। পাশাপাশি নিজেরাও হতে পারেন দুর্ঘটনার শিকার।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডাক্তার মাহবুবুর রহমান মিলনের সাথে এ ধরনের হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা বেলুন ফেটে আগুন লাগলে কি ধরণের ক্ষতি হতে পারে তা জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, একটি বেলুনে যে পরিমাণ গ্যাস ভরা থাকে তা অতিমাত্রায় দাহ্য। এতে আগুন লাগলে একটি ৫ বছর বয়সী শিশুর শরীরের ১০ ভাগ পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ১০ ভাগ পুড়লে ওই শিশুর ভবিষ্যতে বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গত ১৮ ডিসেম্বরে দৈনিক মাথাভাঙ্গায় এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন ছাপা হয় তাতে উল্লেখ করা হয়েছিলো প্লাস্টিকের বোতলে চুন পানি মিশিয়ে সিগারেটের রাংতা কাগজ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গ্যাস। পরে অনুসন্ধানে দেখা গেলো চুন গোলা পানি নয় সরাসরি সালফিউরিক অথবা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ব্যবহার হচ্ছে বেলুন ফোলানো হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরিতে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে মারাত্মক এসব অ্যাসিডের বিক্রি বা উৎস কোথায়? পরিবেশ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স এবং নিয়মনীতি না মেনে অ্যাসিড বিক্রি ও মজুদ আইনত দণ্ডনীয় হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় কীভাবে চলছে এই বেচাকেনা ও অপব্যবহার ? আর তাইতো সাধারণ মানুষের দাবি অবিলম্বে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বড় দুর্ঘটনা ঘটার আগেই এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। গ্যাস তৈরির কারখানাগুলো খুঁজে বের করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা ও এর আশেপাশের এলাকায় এ ধরনের বেলুন বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণও এখন সময়ের দাবি।