পৌর পানি পান পরিহারসহ বাড়তি সতর্কতা : চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা হ্রাস

 

 

ভয়াবহ প্রাদূর্ভাবে রোগীর চাপ সামলে প্রাণহানি রুখতে পারায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা কমলেও গতকাল বুধবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দেড় শতাধিক। এর মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যা ১০। এ দিয়ে গত ৬ দিনে চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। অধিকাংশ রোগীরই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরলেও বেশ কয়েকজন রোগীকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। এরকম রোগীর সংখ্যা ২০’র কম নয়।

চুয়াডাঙ্গা পৌর সরবরাহকৃত পানি পান পরিবহারের আহ্বানে সাড়া দেয়ায় ডায়রিয়া আক্রন্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে মন্তব্য করে ঢাকা রোগ তত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শক দলের সদস্য আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশন অফিসার ডা. ফারহানা হক বলেছেন, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, পৌরসরবরাকৃত পানির পাইপ সুরক্ষিত নয়। দীর্ঘদিন ধরে পাইপ পরিষ্কার না করার কারণে আয়রনসহ ময়লা জমেছে। তা ছাড়া পাইপ লাইন পায়নিষ্কাশন ড্রেনের কোল ঘেষে। ধারণা করা হচ্ছে, পাইপ লিকেজের কারণে ড্রেনের নোংড়া পানি ঢুকেছে। পানির পাইপে যখন পানির চাপ থাকে না তখন লিক দিয়ে ড্রেনের পানি ঢুকতে পারে। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, এ কারণেই চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রকোপ।

গত ১ আগস্ট থেকে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার মাঝেরপাড়া, মসজিদপাড়া, বাগানপাড়া, জিনতলাপড়াসহ পার্শ্ববর্তী মহল্লাগুলোতে ডায়রিয়ার প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়। একের পর এক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকেন। কোনো কোনো পরিবারের সকল সদস্যই ডায়রিয়া আক্রন্ত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজনও ডায়রিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাননি। গতপরশু পর্যন্ত ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়ে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮শ’র অধিক। গতকাল অবশ্য পরশুর তুলনায় প্রায় অর্ধেক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে উপচেপড়া রোগীর চাপ সামলাতে উপজেলা পর্যায় থেকে সেবিকা নিতে হয়। ঝিনাইদহ থেকে দুটি টিমসহ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ৪টি মেডিকেল টিম গঠন করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। গত ৬ দিনে ভয়াবহ ডায়রিয়ার প্রকোপের মাঝেও স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ তৎপরতায় পৌর এলাকার একজন রোগীরও অবম্য প্রাণহানি হয়নি। গতকাল বুধবার চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার হাসপাতাল পরিদর্শনকালে প্রাণহানি রুখতে পারায় চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, চিকিৎসা সেবাদানে চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ যে দক্ষতা দেখিয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। ভর্তি কোনো রোগী যাতে চিকিৎসা বঞ্চিত না হন সেদিকে আরো আন্তরিক দৃষ্টি দিতে হবে। হুইপের সাথে ছিলেন পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৪২ শিশু চিকিৎসাধীন ছিলো। শিশুদের চিকিৎসায় বাড়তি নজর দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি ডায়রিয়া রোগীদের মধ্যে অধিকাংশেরই গতকাল সকাল ৯টা থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। নিচের বারান্দায় থাকা রোগীদের দোতলারর আউটডোর এ হলরুমে নেয়া হয়। ফলে সদর হাসপাতালের নিচের পরিবেশ অনেকটাই স্বাভাবিক চিত্রে ফিরেছে। যদিও গতকাল ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরা রোগীদের মধ্যে মাস্টারপাড়ার রোজিনা, মসজিদপাড়ার নাসিমা, মাঝেরপাড়ার জাহানারা খাতুনসহ কমপক্ষে ২০ জন রোগী বিকেল থেকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করেন। নতুন রোগীদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে নিজেও ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মুক্তিপাড়ার লাভলী, সিনেমহালপাড়ার সায়েরা বেগম অন্যতম।

ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থানীয়দের অধিকাংশেরই অভিযোগ ছিলো, পৌর সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযু্ক্ত। সরবরাকৃত পানি পানেই ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ অভিযোগ প্রথমে পৌর কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে সরবরাহকৃত বিশুদ্ধ বলে দাবি করলেও একদিন পর অবশ্য পৌর সরবরাহকৃত পানি পান না করার অনুরোধ জানানো হয়। বলা হয়, পরীক্ষা-নীরীক্ষা করে সরবরাহকৃত পানির বিশুদ্ধতার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ পানি পান করা যাবে না। তবে সরবরাহককৃত পানি গোসলসহ সাংসারিককাজে ব্যবহার করা যাবে। পৌরসভার এ ঘোষণার পূর্ব থেকেই অমিয় নামের একটি স্থানীয় কোম্পানি আক্রান্ত এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ শুরু করে। এ কাজে যোগ দেয় বিজিবি। বিজিবি পৌর এলাকার আক্রান্ত এলাকা ক্যাম্প করে বিশুদ্ধ পানি বিতরণের সাথে সাথে ডায়রিয়ার প্রাথমিক ওষুধ খাওয়ার স্যালাইন সরবরাহ করে। হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ার আশঙ্কায় বিজিবি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কয়েকটি তাঁবুও গাঁড়ে। অবশ্য তাবুগুলো গতকাল পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়নি। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা থেকে পৃথক দুটি টিম চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করেছে। আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি পৌর সরবরাহকৃত পানি ও রোগীদের মল সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে আসতে এখনও দু দিন লাগতে পারে। অপরদিকে চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ গত ৩ আগস্ট পানি পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করলেও গতকাল পর্যন্ত তার রিপোট হাতে আসেনি বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, রিপোর্ট হাতে না পৌঁছুলেও আমরা পূর্বের মতোই ধারণা করছি, পৌর সরবরাহকৃত পানির মাধ্যমেই ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়েছে। সে কারণে পরবর্তী ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পৌর সরবরাহকৃত পানি পান থেকে বিরত থাকতে হবে। টিউবওয়েলের পানি অথবা পানি ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করেই পান করতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বাগানপড়ায় গতকাল পর্যন্ত ১৪৭ জন, মসজিদপাড়ার ১১২ জন, মাঝেরপাড়ার ৯৪ জন, জিনতলাপাড়ার ৮৯ জন, আরামপাড়ার ৩৬ জন, মুক্তিপাড়ার ১৭ জন, পোস্ট অফিসপাড়ার ২৫ জন, শেকরাতলাপাড়ার ১৫ জন, পৌর এলাকার অন্য পাড়ার ২৭০ জন। এ ছাড়াও বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১শ’ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বিভিন্ন গ্রামের রোগীদের মধ্যে কেউ কেউ পৌর এলাকার অস্থায়ী বাসিন্দা বলে জানিয়েছেন।