পুলিশি তদন্তে অগ্রগতি : সন্ত্রাসী গ্যাঙের সহযোগিতা করতে রাজি না হওয়ায় মন্টু খুন

দামুড়হুদার জয়রামপুরে খুন আতঙ্কে দোহারধারের বাসিন্দারা ছেড়েছে ঘরবাড়ি : মন্টুর দাফন সম্পন্ন

 

দামুড়হুদা প্রতিনিধি:দামুড়হুদার জয়রামপুরে একের পর এক ঘুমন্ত মানুষকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন ও ক্ষতবিক্ষত করার নেপথ্য উন্মোচনে পুলিশ অনেকটাই এগিয়েছে। কয়েকজনকে আটক করলেও তিনজনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। এরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘুমন্ত মানুষকে খুন ও শিশুসহ একাধিক ব্যক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের নিকট থেকে ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশসূত্র বলেছে, জয়রামপুরে সম্প্রতি গজে ওঠা সন্ত্রাসী গ্যাঙের সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণেই পরশু রাত সাড়ে ১২টার দিকে জলাশয়ের নৈশপ্রহরী মন্টুকে খুন করা হয়েছে। নৈশপ্রহরীর কাজ করার ফাঁকে সন্ত্রাসীদের গোপন সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতে বলেছিলো সন্ত্রাসীরা তাকে। তারা বলেছিলো, সড়কে পুলিশের গতিবিধি মোবাইলফোনে তাদেরকে জানাতে হবে। এতে রাজি হয়নি মন্টু। এ কারণে মন্টু সন্ত্রাসীদের পরিচয় ফাঁস করে দিতে পারে আশঙ্কায় ডাক্তারপাড়ার আলমগীরসহ তার সহযোগীরা কিলিংমিশনে নামে। খুনের সময় একাধিক ব্যক্তি ছিলো বলেও তথ্য পেয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টসূত্র বলেছে, গ্রেফতারকৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে পারে। আলমগীরকে আটক করা হয়েছে বলে গ্রামসূত্র দাবি করলেও পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।

দামুড়হুদার জয়রামপুর চৌধুরীপাড়ায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত জলাশয়ের নৈশপ্রহরী মন্টুকে বেদনাবিধুর পরিবেশে তার পিতার কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বাদ আছর জয়রামপুর গ্রামের কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। দুপুরে নিহত মন্টুর মা হাজেরা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জনের নামে থানায় হত্যামামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ গত মঙ্গলবার রাতেই অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে ৩ জনকে আটক করে থানাহাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে। গ্রেফতারকৃত ৩ জন হলেন- জয়রামপুর মল্লিকপাড়ার আব্দুস সাত্তারের ছেলে জাহিদ (২৮), একই গ্রামের ডাক্তারপাড়ার লালচাঁদ মণ্ডলের ছেলে বাবু (৩৫) ও বারুইপাড়ার মৃত রবিউল ইসলামের ছেলে আসান ওরফে তোতা (৩৫)। অপরদিকে গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান ও সহকারী পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে বলেন, জয়রামপুরে একের পর এক হামলার ঘটনার নেপথ্য উন্মোচনের পথে। মৌলবাদী কোনো চক্রের অশুভচক্রান্ত রয়েছে কি-না তাও যথাযথভাবে গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে গোটা জয়রামপুরে খুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। দোহারধার এলাকায় সরকারি খাসজমিতে বসবাসরত ৪টি পরিবারই খুন আতঙ্কে এলাকাত্যাগ করেছে। নিহত মন্টুর মা, স্ত্রী, সন্তানসহ সকলেই তাদের পৈত্রিক ভিটে দামুড়হুদার রঘুনাথপুরে ফিরে গেছে।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে জয়রামপুর চৌধুরীপাড়ার দোহারধারে খাসজমিতে বসবাসকারী মৃত ছমির উদ্দিন ওরফে নূর হোসেনের ছেলে নৈশপ্রহরী মন্টুকে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে ঢুকে অতর্কিত ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলাকেটে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পুলিশ ভোরে লাশ উদ্ধার করে থানায় নেয় এবং সকাল ১০টার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে নেয়। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল তার নিজ গ্রামে পিতার কবরের পাশে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। গত ১৫ দিন ধরে জয়রামপুরে রাতের আঁধারে একের পর এক বাড়িতে হামলা চালিয়ে ঘুমন্ত নারী-পুরুষ ও শিশুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। দুজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫ জন। এরা সকলেই দরিদ্র।

দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি শিকদার মশিউর রহমান জানান, ঘটনার সাথে জড়িত ঘাতকদের ধরতে পুলিশ রাতেই জোর তৎপরতা শুরু করে এবং ভোররাতে মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা তারা স্বীকার করেছে বলেও তিনি জানান। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক পুলিশ আসানের বাড়ি থেকে ২টি ডাসা, ৩টি ভুজালি, ১টি চাকু ও বাবুর বাড়ি থেকে একটি হেঁসো উদ্ধার করে।গ্রেফতারকৃত ৩ জন হলেন- উপজেলার জয়রামপুর মল্লিকপাড়ার আব্দুস সাত্তারের ছেলে জাহিদ (২৮), একই গ্রামের ডাক্তারপাড়ার লালচাঁদ মণ্ডলের ছেলে বাবু (৩৫) ও বারুইপাড়ার মৃত রবিউল ইসলামের ছেলে আসান ওরফে তোতা (৩৫)। গ্রামে পুলিশি টহল জোরদার ও গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রাখলেও গোটা জয়রামপুরে খুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। সন্ধ্যা হতে না হতে গ্রামের রাস্তায় নেমে আসছে শুনশান নীরবতা। ভ্যাপসা গরমেও ঘরের বারান্দায় ঘুমোনোর কথা ভাবতেও পারছেন না কেউ। দোহারধার এলাকায় সরকারি খাসজমিতে বসবাসরত মৃত রমজান মণ্ডলের ছেলে শাহাবদ্দিন ওরফে বদ্দি, অপর বাসিন্দা তুলা শ্রমিক মৌসুমির নানি রাবেয়া খাতুন খুন আতঙ্কে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে এলাকাত্যাগ করেছেন। নিহত মন্টুর মা হাজেরা বেগম, স্ত্রী মনমিলা খাতুন সন্তানসহ সকলেই তাদের পৈত্রিক ভিটে উপজেলার রঘুনাথপুরে ফিরে গেছেন।

           নিহত মন্টুর পরিচয়: দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের রঘুনাথপুরের হতদরিদ্র নূর হোসেন কাজের সন্ধানে প্রায় বছর ২৫ আগে জয়রামপুরে চলে যান। চৌধুরীপাড়ার দোহারধারে সরকারি খাসজমিতে কুঁড়েঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেন। ৩ বছর আগে তিনি মারা যান। পিতার অবর্তমানে সংসারের হাল ধরেন মন্টু। মা,স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে ভ্যানচালিয়ে কোনোমতে চলতো তাদের সংসার। দিন দশেক আগে সে ওই দোহার পাহারাদার হিসেবে কাজ শুরু করে। নিহত মন্টু ৩ সন্তানের জনক। বড় ছেলে মনিরুল (১৫), মেজ ছেলে মামুন (১২) এবং ছোট ছেলে মাহফুজ (৬)। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী মন্টুকে হারিয়ে মা হাজেরা বেগম ও স্ত্রী মনমিলা খাতুন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।