পদ্মায় লঞ্চডুবি :নিখোঁজ শতাধিক : মাওয়া লঞ্চঘাটে শোকের মাতম

 

উদ্ধার হওয়া প্রথম লাশটি মেডিকেল ছাত্রী হিরার : সন্তান হারা পিতাসহ শ’ শ’ মানুষের আহাজারি

স্টাফ রিপোর্টার: আবারও লঞ্চ ডুবি। এবার ঈদশেষে ঢাকায় কর্মস্থলে ফেরার পথে ঘটলো এইদুর্ঘটনা। ধারণ ক্ষমতার আড়াইগুণের বেশি অর্থাত্ আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়েমাদারীপুরের কাওড়াকান্দি থেকে ছেড়ে আসা এমএল পিনাক-৬ নামের লঞ্চটিমুন্সীগঞ্জের মাওয়া লঞ্চঘাট থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে পদ্মা নদীতেগতকাল সোমবার সকাল ১১টার দিকে ডুবে যায়। এর মধ্যে সাঁতরে ওউদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় অনেকেই তীরে উঠতে সক্ষম হন। এরপরও গতকাল রাত সাড়ে৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ ছিলো।

নিখোঁজযাত্রীদের স্বজনদের আহাজারিতে মাওয়া ঘাটের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।দুর্ঘটনার সময় দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে আহত অবস্থায় উদ্ধার করাআরো চার যাত্রী মারা যায়। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে ১২ জনকেমুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

সিকদার মেডিকেল কলেজের ছাত্রী নূসরাত জাহান হিরা (২০) ও সিটি কলেজেরছাত্রী ফাতেমা তূজ জোহরা স্বর্ণাকে (১৮) নিয়ে বাবা নুরুল হক রওনাদিয়েছিলেন ঢাকার উদ্দেশে। সাথে ছিলো খালাতো বোন জান্নাত নাঈম লাকী।মাওয়া ফেরি ঘাটে ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রী হয়েছিলেন তারা সবাই। তীরে উঠেমেয়েদের হারিয়ে বুক চাপড়াতে থাকেন নুরুল হক। কিছুক্ষণ পর খুঁজে পান হিরারলাশ। উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর মধ্যে প্রথম লাশটিই তার বড় মেয়ে হিরার। মেয়েরলাশ পেয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন বাবা।

শুধু নুরুল হকই নন পদ্মারপাড়ে তার মতো শত শত মানুষের কান্না আর আহাজারিতে পদ্মার পাড়ের বাতাস ভারিহয়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাদি (৪০) বুক চাপড়াতে চাপড়াতে গড়াগড়িখাচ্ছেন। ঈদে বাড়িতে বাবার সাথে দেখা করে ঢাকায় ফেরার পথে লঞ্চ ডুবিতেহারিয়ে ফেলেছেন স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে। ঝালকাঠির নলছিটি থেকে আসা হনুফাবেগম স্বামী হেমায়েত হাওলাদার ও দেবর বাবুল হাওলাদারকে খুঁজে না পেয়েমূর্ছা যাচ্ছেন বার বার। কাঁদতে কাঁদতে হনুফা বললেন, লঞ্চ ডুবে যাওয়ার সময়স্বামীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আচমকা এক ঢেউয়ে স্বামীর হাত থেকে হাত ছুটেযায়। মনে হল চিরদিনের জন্য এই বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেলো।

ফরিদপুরেরকালকিনির নিলুফার তার খালাতো ভাই দাদন ও মেয়ে ইতিকে নিয়ে ঢাকারকামরাঙ্গীরচরে স্বামীর বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। খালাতো ভাই আর মেয়েকেখুঁজে না পেয়ে এখন তিনি পাগলপ্রায়। বরিশালের উজিরপুরের মিজানুর রহমান নয়বছরের সন্তান ইন্তাজকে সাথে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন ঢাকায়। এখনো খোঁজমেলেনি প্রিয় সন্তানের। সুজন (২৫) খালাতো ভাই বোন মিরাজ (৯), ইব্রাহিম (১৭) ও ইপাকে (১৫) সাথে নিয়ে মাদারীপুরের শিবচর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনাদিয়েছিলেন। সুজন জীবিত উদ্ধার হলেও বাকি তিনজনের এখনো খোঁজ মেলেনি। লঞ্চঘাটে স্থাপিত নিখোঁজদের অস্থায়ী ক্যাম্পে এসে ভাই-বোনদের জন্য বিলাপকরছিলেন সুজন। আপনজনকে আর জীবিত খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে অন্তত মৃতদেহটিপেতে অধীর আগ্রহে পদ্মার পাড়ে অপেক্ষা করছেন হাজারো মানুষ।
নিহত ৬জনের মধ্যে ৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন মাদারীপুরের শিবচরের হিরা (২০), ফরিদপুরের ভাঙ্গার আবদুল আজিজ (৪৫), একই এলাকার কমল মণ্ডল (২২), মাদারীপুরের বাতেন আলী (৪৫) ও মাদারীপুরের শিবচরের গার্মেন্টস কর্মীআনোয়ার হোসেন (২৫)। এছাড়া পরিচয় না পাওয়া অপর এক বৃদ্ধার বয়স আনুমানিক ৬৫বছর।

বিআইডাব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, পিনাক-৬ লঞ্চটির সর্বোচ্চধারণ ক্ষমতা ১১৫ জন। লঞ্চটির মালিক মাওয়া এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিক কালুমিয়া। দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, বিআইডাব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকারসহ ঊর্ধ্বতনকর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী ও বিআইডাব্লিউটিসির ডুবুরিরাও নামেনিখোঁজদের উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু প্রবল স্রোতের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেউদ্ধার কাজ।

উদ্ধার কাজ চালাতে বিআইডাব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজহামজা বরিশাল থেকে রওনা দিয়েছে। আরেক উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি রুস্তমনারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে দুর্ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়।বিআইডাব্লিউটিএ চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার জানান, ডুবুরিরা লাশের সন্ধান করছে। তবে প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহতহচ্ছে। তবে মঙ্গলবার ভোর থেকে ভাটির দিক থেকে লাশ উদ্ধার করা হতে পারে।ঘটনারপর পর মাওয়া লঞ্চ ঘাটে নিখোঁজদের স্বজনরা ভিড় করতে থাকে। তাদের আহাজারিআর কান্নায় এক বিভীষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা হয়। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে চিত্কারকরতে থাকেন। কেউ বুক চাপড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছেন। লঞ্চ ঘাটেবিআইডাব্লিউটিএ, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপার কার্যালয় ক্যাম্পখুলেছে।

লৌহজং থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন জানান, রাত ৯টা পর্যন্ত ৭৩ জননিখোঁজ রয়েছেন বলে তালিকা করা হয়েছে। নিখোঁজদের স্বজনরা ভিড় করছেনক্যাম্পে। কেউ তার ভাই, কেউবা তার স্ত্রী আবার কেউবা পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করছেন।

যেভাবেলঞ্চ ডুবে যায়: প্রত্যক্ষদর্শী লঞ্চের যাত্রী রিপন মিয়া জানান, ফরিদপুরেরভাঙ্গায় শ্বশুরবাড়িতে সপরিবারে ঈদ উদযাপন করতে গিয়েছিলেন। গতকাল ঢাকায়ফেরার জন্য কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে এমএল পিনাক-৬ লঞ্চে ওঠেন। সাথে ছিলো তারস্ত্রী সীমা ও ছয় মাসের সন্তান জান্নাত। ঈদে ঢাকামুখি মানুষের কারণে লঞ্চেযাত্রী ছিলো ঠাসাঠাসি। লঞ্চটি মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি আসার সময় যাত্রীরা নামারজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বেশিরভাগ যাত্রী লঞ্চের ডেকের একদিকে অবস্থাননেয়। এসময় প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইছিলো। লঞ্চের সামনের দিক থেকে একটি বড় ঢেউএসে ভেতরে আছড়ে পড়ে। এতে লঞ্চের ভেতরে পানিতে ভেসে যায়। এক পর্যায়ে যে দিকেযাত্রীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, ওই দিক হেলে পড়ে। চারদিক চিত্কার, হাউমাউ কান্নারশোরগোল পড়ে যায়। তার স্ত্রীর কোলে জান্নাত ছিলো। স্ত্রী তলিয়ে গেলো। তারওপর আরো ৫/৬ জন মানুষ পড়ে গেলো। তিনি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর সাঁতরিয়েওঠেন। তীরে এসে খুঁজতে থাকেন তার স্ত্রী ও জান্নাতকে। অনেকক্ষণ পর দেখেনতীরে সীমা বুক চাপড়িয়ে কান্নাকাটি করছেন। পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় সীমারকোল থেকে জান্নাত ছিটকে পড়ে। জান্নাতকে তিনি আর খুঁজে পাচ্ছেন না।

পদ্মাতীরে দেখা গেলো, ১২ বছরের সীমা আক্তার কাঁদছেন। সে জানালো, তার বাবা-মা ওভাই-বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের শিবপুরেরচাঁন্দেরচর গ্রামে। তার কান্নাকাটি দেখে ঘাটের ক্যাম্পের পুলিশ তাকেহেফাজতে নেয়। এই শিশু এখন কী করবে তা বুঝতে পারছে না। সীমা জানায়, লঞ্চডুবে যাওয়ার সময় সে তার মাকে জড়িয়ে ধরেছিলো; কিন্তু পানির মধ্যে হাবুডুবুখাওয়ারও সময় কে বা কারা তাকে টেনে একটি ট্রলারে তোলে; কিন্তু বাবা-মা, ভাই-বোনের খোঁজ পায়নি। তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও সে জানে না।

বেঁচেযাওয়া যাত্রীদের মধ্যে রুবেল জানান, মাদারীপুরের শিবচরের কাদিরপুরে বাড়ি।ঈদ শেষে দুই বোন, দুই ভাগ্নে-ভাগ্নিসহ তারা ঢাকায় যাওয়ার জন্য ওই লঞ্চেচড়েন। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার সময় তিনি দোতলায় ছিলেন। পরে তার এক বোন ও ভাগ্নিউদ্ধার হলেও ছোট বোন ফালানি এবং ভাগ্নি এখনো নিখোঁজ। বগুড়া সেনানিবাসেরসৈনিক আলামিন তার পরিবারের পাঁচ সদস্যসহ নিখোঁজ রয়েছেন।

দুর্ঘটনাস্থল: মাওয়া লঞ্চঘাট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর মিডপয়েন্টে এইলঞ্চটি ডুবেছে। বিআইডাব্লিউটিএ-এর সূত্র মতে নদীর এই পয়েন্টটি সবচেয়েঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ডুবোচরে প্রায়ই লঞ্চ আটকে যায়। এই কারণে এই এলাকা দিয়েবেশিরভাগ লঞ্চ ঘাটে ভিড়ে না; কিন্তু ঘটনার সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, লঞ্চটি তড়িঘড়ি করে ঘাটে ভিড়ানোর জন্য হয়তো চালক এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাদিয়ে লঞ্চ চালিয়েছিলো। বিআইডাব্লিউটিএ-এর অপর একটি সূত্র জানায়, প্রচণ্ডবাতাস ও স্রোতের কারণে লঞ্চটি দিক থেকে সরে গিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়আসে।

ফায়ার সার্ভিস ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমানজানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩০ সদস্য উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয়। ছয়ডুবুরী পানিতে লাশের সন্ধান করতে থাকে; কিন্তু তাত্ক্ষণিকভাবে মাত্র দুইটিলাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, লঞ্চে আড়াইশর মতো যাত্রী ছিলো। তবে এই ধরনের লঞ্চে এটি অতিরিক্ত যাত্রীছিলো। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও প্রচণ্ডস্রোতের কারণেই লঞ্চটি ডুবে গেছে।

তদন্ত কমিটি: ঘটনার তদন্তেদুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (টাস্কফোর্স) নূর-উর-রহমানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্যসদস্যরা হলেন- বুয়েটের একজন প্রতিনিধি, বিআইডাব্লিউটিএ-এর সদস্য (প্রকৌশল), বিআইডাব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরেরচীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার, মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও মাদারীপুরের জেলাপ্রশাসক। কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়াসমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ওই অধিদফতরের ইঞ্জিনিয়ার ও শিপ সার্ভেয়ার নাজমুল হককেপ্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির অন্য সদস্যরাহলেন- সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন, মেরিন সেফটির বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ও মুখ্য পরিদর্শক শফিকুলইসলাম। এই কমিটিকেও ১০ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।