পথে পথে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা : সাংবাদিকসহ আহত শতাধিক

চুয়াডাঙ্গায় বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল : নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশি তল্লাশি

স্টাফ রিপোর্টার: সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে দফায় দফায় হামলা করা হয়েছে। ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সীগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি স্থানে তার গাড়িবহর আটকে দেয়ার চেষ্টা চালায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। তারা পথে পথে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালায়। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মী ও সাংবাদিকসহ অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এ ছাড়া অর্ধশত গাড়ি ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। দলীয় কার্যালয়ে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে বড় বাজার চৌরাস্তা মোড়ে পৌছুলে পুলিশের ধাওয়া ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় নেতৃবৃন্দ। বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনিপর যুগ্মআহ্বায়ক অ্যাড. ওয়াহেদুজ্জামান বুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক মজিবুল হক মালিক মজু, শহিদুল ইসলাম রতন, আশরাফ বিশ্বাস মিল্টু, রবিউল মল্লিক, জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শরিফ উজ জামান সিজার, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ তালহা যুগ্ম আহ্বায়ক মঞ্জুরুল জাহিদ প্রমুখ। পরে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাড. ওয়াহেদুজ্জামান বুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক মজিবুল হক মালিক মজু ও জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শরিফ উজ জামান সিজারের বাড়ি পুলিশ দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাসী করে। এ সব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা ও বাধার মুখে শনিবার রাতে খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম পৌঁছেছেন। তার সঙ্গে থাকা বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, সাংবাদিক ও বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর যে হামলা হয়েছে সেটি নিন্দনীয় যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন খালেদা জিয়া। শিমুল বিশ্বাস আরও জানান, খালেদা জিয়ার নির্দেশে তিনি হামলার শিকার সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিয়েছেন। ফেনী শহরে প্রবেশের চার কিলোমিটার আগে মোহাম্মদ আলী বাজারে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালায়। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের বহনকারী গাড়ি এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ বিভিন্ন সংস্থার সাংবাদিক বহনকারী অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাংচুর করা হয়। হামলায় সাংবাদিকসহ অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন, জিয়াউল আহসান (১৯), কাওসার আহম্মদ (১৭), মো. মাসুদ (৪৫) প্রমুখ। ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকে তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে জিয়াউল আহসান ও কাওসার আহম্মদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মোহাম্মদ আলী বাজারের ফতেহপুরে ১৫-২০ জনের একটি দল লাঠিসোটা নিয়ে সড়কে উঠে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আটকে দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় কয়েকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ সদস্যদের নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায়। একাত্তর, ডিবিসি, চ্যানেল আই ও বৈশাখী টেলিভিশন, একুশে টিভি, বাংলা ভিশন, এটিএন নিউজের গাড়ি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের একটি মাইক্রোবাসও হামলার মুখে পড়ে। একাত্তর টিভির আলোকচিত্রী আলম হোসেন, সিনিয়র প্রতিবেদন শফিক আহমেদ গুরুতর আহত হয়েছেন। কালের কণ্ঠ, নয়া দিগন্ত, যুগান্তর, যায়যায়দিন, গাজী টিভি, আমাদের সময়, নিউএজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাও হামলার শিকার হন। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী মারধরের শিকার হন। একাত্তর টিভির এক কর্মী ভিডিও ধারণ করতে গেলে মারধরের শিকার হন। একজন হামলাকারী দৌড়ে এসে ওই আলোকচিত্রীকে বলেন, ‘একাত্তর-মেকাত্তর বুঝি না, তুই ক্যামেরায় ছবি কিল্লাই তুললি? তোর ক্যামরা ভাঙিয়া হালামু।’ এ সময় ক্যামেরা নিয়ে টানা-হেঁচড়া করে তারা। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে লাঠি হাতে গাড়ির সামনে গ্লাস ভাংচুর করতে থাকে। বিএনপির মহানগর দক্ষিণসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গাড়িও ভাংচুর করা হয়। হামলার শিকার সাংবাদিকরা ফেনীর লালপুরের একটি খাবার হোটেলে গেলে সেখানে ক্ষমতাসীন দলের একদল সন্ত্রাসী বলেন, ‘আপনারা এখান থেকে চলে যান। ওপরের নির্দেশনা আছে। নইলে বড় ধরনের বিপদ পড়বেন। কেউ রেহাই পাবে না।’ এই হুমকির মুখে সাংবাদিকরা না খেয়ে হোটেল ত্যাগ করেন। ঢাকা মহানগর বিএনপির দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার জানান, তাদের বহরে থাকা মহানগর দক্ষিণের ১১টি গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। হামলাকারীরা বহরে গাড়িগুলো বেছে বেছে ভাংচুর করে। তারা দূরপাল্লার বাসসহ ট্রাক ও প্রাইভেট কার ভাংচুর করেনি।
গাড়িবহরে থাকা সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ ও খন্দকার মাশুকুর রহমান জানান, সড়কের দুই ধারের যে বিপুল পরিমাণ মানুষ খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে দেখেছি এর আগে কোনো নেতানেত্রীর ক্ষেত্রে দেখিনি। এটা সহ্য করতে না পেরে গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেছেন, দুপুরের দিকে দাউদকান্দিতে বিএনপির কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করেছে ছাত্রলীগের সশস্ত্র যুবকরা। তার নিজের গাড়িতেও হামলা হয়েছে। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, মুন্সীগঞ্জের ববের চর ও কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জের কাছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে।ফেনীতে বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, যাত্রাবিরতির সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎ ঠেকাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ ছাড়া শুক্রবার রাতে নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা।

বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানান, চট্টগ্রামমুখী খালেদা জিয়ার বহরে দেড় শতাধিক গাড়ি রয়েছে। ফেনী সার্কিট হাউসে যাত্রাবিরতি করে ৬টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ফেনী ত্যাগ করেন খালেদা জিয়া। এর আগে ফেনী সার্কিট হাউসে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, প্রচার সম্পাদক শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ফেনী জেলা সভাপতি আবু তাহের, সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিস্টার, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রেহানা আখতার রানু প্রমুখ। চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়ার সময় তার নিরাপত্তাকর্মী ছাড়াও ছাত্রদলের রাজিব আহসান, আকরামুল হাসান, যুবদলের সাইফুল আলম নীরব, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের শফিউল বারী বাবু, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলসহ অঙ্গসংগঠনের কয়েকশ’ নেতাকর্মী খালেদা জিয়ার গাড়ি কর্ডন করে সামনের দিকে অগ্রসর হন। খালেদা জিয়ার গাড়ির সঙ্গে সিনিয়র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বরকতউল্লাহ বুলু, নিতাই রায় চৌধুরী শামসুজ্জামান দুদু রয়েছেন। তবে হামলার ভয়ে অনেকে বহর থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
শনিবার ১০টা ৪০ মিনিটে গুলশানের বাসা ফিরোজা থেকে ৪ দিনের সফরে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের উদ্দেশে বের হন খালেদা জিয়া। এ সময় তার গাড়িতে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য খালেদা রব্বানী ও খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। গুলশান থেকে রওনা হওয়ার সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদুসহ ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ নেতাকর্মীদের অর্ধশতাধিক ও সংবাদমাধ্যম কর্মীদেরও কয়েক ডজন গাড়ি খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের সঙ্গে ছিলো। সামনে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মী ও গাড়িবহরে গাড়ির সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অভ্যর্থনায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে বিকালে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানাধীন টি বোর্ডের সামনে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় বিএনপি ও ছাত্রদলের অন্তত ৫-৬ জন নেতাকর্মী আহত হন। হামলায় আহত সাবেক ছাত্রদল নেতা সৈয়দ মঞ্জুর হোসেনসহ দু’জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী জানান, বায়েজিদ থানাধীন চা বোর্ডের সামনে স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীরা বাস থামিয়ে লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিএনপিও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর। এতে অন্তত ৬ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।

মিরসরাই প্রতিনিধি জানান, মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এতে কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। এ সময় হামলাকারীরা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসংবলিত পোস্টারে আগুন ধরিয়ে দেয়।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা ঠেকাতে ভোর থেকে ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কের সেনবাগের সেবারহাট বাজারে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এতে রাস্তার দুই পাশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর অভিমুখী হাজার হাজার গাড়ি আটকা পড়ে।

মুন্সীগঞ্জের প্রতিনিধি জানান, খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গজারিয়ার বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের ঢল নামে। বেলা আড়াইটা নাগাদ খালেদা জিয়ার গাড়িবহর গজারিয়া পার হয়। এদিকে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভবেরচর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আটকে দেয়ার চেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
কুমিল্লা ব্যুরো জানায়, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও চান্দিনায় বিএনপি এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে। এতে ১০-১২ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে।

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, দেবিদ্বার উপজেলার নুরীতলা ও ইটাখলায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে বিএনপির ১৫-২০ জন এবং আওয়ামী লীগের ২ নেতা আহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে আসা বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই সংঘর্ষ হয়। ওই সময় বিএনপি কর্মীদের ৪টি মোটরসাইকেল ভাংচুর ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।