নির্বাচনী প্রশাসন সাজানো শুরু

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আস্থাভাজন ও পছন্দের কর্মকর্তাদের দিয়ে সাজানো হচ্ছে মাঠ প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২ মে ১৮ নতুন ডিসি নিয়োগ ও ৬ জনকে রদবদল করা হয়েছে। এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ ও রদবদল করা হয়। শিগগির আরও কয়েকটি জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা যায়, সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদেরই নতুনভাবে জেলা প্রশাসকের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। কারণ, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে উন্নয়নমূলক চলমান প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য সরকারের আস্থাভাজন, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে পাঠানো হয়েছে। গুরুতর কোনো অনিয়মের অভিযোগ না উঠলে এসব কর্মকর্তাকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রত্যাহার বা বদলির সম্ভাবনা খুবই কম। এদিকে নির্বাচনী কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনী মাঠে যদি কোনো দলের পছন্দের কর্মকর্তারা কাজ করেন তাহলে সে দলের পক্ষে অনেকভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক বলেন, প্রশাসন সাজানোর কিছু নেই। প্রশাসনের বদলি-নিয়োগ ও পদোন্নতি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই এ কাজগুলো নিরপেক্ষভাবে করা হয়। সে চিন্তাভাবনা থেকেই কয়েকটি জেলার ডিসি পদে রদবদল করা হয়েছে, যা আগামীতেও করা হবে। আর প্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে একটি তালিকা তৈরি করা হয়, এটি নতুন কিছু নয়। মাঠ প্রশাসনে যে কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন, তাদের তো পরিবর্তন করতে হবে। তাদের স্থলে পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের একটি ফিটলিস্ট করা প্রয়োজন। আর সেটিই করা হয়। মাঠ প্রশাসনের এসব রদবদল ও পরিবর্তন কোনো দলীয় চিন্তাভাবনা থেকে করা হয় না। সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়। এ জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ডিসি ফিটলিস্ট তৈরি করে। তার ভিত্তিতেই নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি মনে করেন শুধু ডিসি নয়, এসপি, ইউএনও এবং ওসি নিয়োগও মেধার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। রাজনৈতিক বিবেচনায় না হওয়াই উত্তম। কারণ, সরকারের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনে যোগ্য কর্মকর্তাদের দরকার।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, শিগগির মাঠ প্রশাসনের ডিসি, এডিসি ও ইউএনও পদে বেশ কিছু কর্মকর্তার দপ্তর বদলের সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদিকে প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কর্মকর্তারা এখন আর মাঠ প্রশাসনে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আচরণে বেশির ভাগ জায়গায় কর্মকর্তারা খুবই বিরক্ত। তবে যেসব কর্মকর্তা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান, তারা নিজ আগ্রহে ডিসি, এডিসি ও ইউএনও পদে যাওয়ার জন্য তদবির করেন। সরকারি দলের একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য দলের ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দলীয় প্রার্থীর অনিয়ম ও অপকর্মগুলো কঠোর হস্তে দমন করা করা হবে। প্রার্থী বাছাইয়ের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাদের এবার মনোনয়ন দেয়া হবে না। নেতারা বলেন, একইভাবে মাঠ প্রশাসনেও কোনো ধরনের অনিয়ম বরদাশত করা হবে না। যদি কারও বিরুদ্ধে অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এর আগে জাতীয় নির্বাচনকালীন ডিসি, ইউএনও এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ ও কঠোর হোক না কেন যেসব কর্মকর্তা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট পদে দায়িত্ব পালন করবেন, তারা সত্যিকার নিরপেক্ষ না হলে সুকৌশলে ও সূক্ষ্মভাবে নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কারণ, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফল গণনা পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ করা হয়। এতে কেউ যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন না করে বিশেষ কোনো দল বা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চাইলে অনেক সুযোগ থাকে। যেমন- জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা নিজেদের মতো করে পোলিং অফিসার, প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দিতে পারেন। ফলে ভোট কারচুপির পরিকল্পনা থাকলে আস্তাভাজন এসব কর্মকর্তাকে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

কর্মকর্তারা আরও বলেন, বিশেষ করে অনেক আগের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসনে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন একযোগে কাজ করলে তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন দেশের সব কয়টি আসনকে টার্গেট না করে সর্বোচ্চ ১০০ আসনকে টার্গেট করে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট পদে পছন্দের কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়। এখানে কর্মকর্তারা যে প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করবেন তার ভোট ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ভোট কেন্দ্রগুলো মূলত টার্গেটের আওতায় আনা হবে। ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর যখন বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি তৈরি হবে তখন কৃত্রিমভাবে তুচ্ছ ঘটনা সৃষ্টি করে পুলিশকে দিয়ে লাঠিচার্জ করা হবে। এতে ভয় ও আতঙ্কে মহিলাসহ সাধারণ ভোটারদের অনেকে ভোট না দিয়েই চলে যাবেন। এ রকম আরও অনেক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ফলে এসব কেন্দ্রে যে প্রার্থীর বিপুল ভোটে পাস করার কথা ছিলো, তা আর হয় না। বিপরীতে যে প্রার্থীর পক্ষে প্রশাসন কাজ করবে তার ভোট ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোতে সব বিষয়ে ব্যাপক ছাড় দেয়া হবে। ফলে নানাভাবে ও নানা প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে এসব ভোট কেন্দ্রে যে ভোটের ব্যবধানে ওই প্রার্থীর পাস করার কথা ছিলো, বাস্তবে দেখা যাবে তার চেয়ে তিনি অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। আর এ সূক্ষ্ম ভোট কারচুপির মোট হিসাবে দেখা যাবে, যেখানে যার পাস করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো তিনি সেখানে পরাজিত হবেন।