নাশকতায় ট্রেনের ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে নিহত ৪ : সহিংসতায় নিহত ৫

১৩১ ঘণ্টার টানা অবরোধ শেষ হচ্ছে আজ : সারাদেশে ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয় : খুলনায় গোয়ালন্দ মেল লাইনচ্যূত

 

স্টাফ রিপোর্টার: ১৩১ ঘণ্টার টানা অবরোধ শেষ হচ্ছে আজ বিকেল ৫টায়। অবরোধের পঞ্চম দিনেও দেশব্যাপি রেললাইনে ব্যাপক সহিংসতা, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ১৮ দলের ডাকে অবরোধের ৫ম দিনে বুধবার গাইবান্ধায় রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে রাখায় ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে কাত হয়ে পড়ে। এতে ৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬০ জন। এছাড়া চাঁদপুর ও খুলনায় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। বিপর্যয় ঘটেছে ট্রেনের সিডিউলে। এছাড়া পুলিশের গুলিতে ফেনীতে যুবদল নেতা হারুন-অর রশিদ, নওগাঁয় আতাউর রহমান, ঢাকার নবাবগঞ্জে যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম ও কিশোরগঞ্জে অবরোধকারীদের ধাওয়ায় ট্রাক উল্টে ট্রাকমালিক উজ্জ্বল সরকার নিহত হন। দু দফা অবরোধে সারাদেশে এ পর্যন্ত ৪৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রথম দফা তিন দিনের অবরোধে নিহত হয়েছেন ২২ জন। দ্বিতীয় দফা ১৩১ ঘণ্টা অবরোধের পাঁচ দিনে সারাদেশে অন্তত ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন সহস্রাধিক।  হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে ও নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে গাজীপুর, ফরিদপুর, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, ফেনী, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে আজ হরতাল ডেকেছে ১৮ দল।
নাশকতার কবলে পড়ে লালমনিরহাট-সান্তাহার রেলপথে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের বুরুঙ্গি এলাকায় মঙ্গলবার রাত দেড়টায় সান্তাহারগামী ২২নং ডাউন পদ্মরাগ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ইঞ্জিন ও ৩টি বগিসহ লাইনচ্যুত হয়। এতে ১ নারীসহ ৪ যাত্রী নিহত এবং অপর ৬০ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার পর থেকে ওই পথে সব ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনাটিকে পরিকল্পিত নাশকতা বলে অভিহিত করেছে। ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে দুর্ঘটনাস্থল থেকে রাতেই স্থানীয় লোকজন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের শ্রীপতিপুর গ্রামের হাফিজার রহমানের ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও একই গ্রামের তছলিম উদ্দিনের ছেলে দুদু মিয়াকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বকুল জানান, গ্রেফতারকৃতরা শিবির ও জামায়াতের কর্মী। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে শাবল ও রেঞ্জ পাওয়া গেছে। আহতদের বোনারপাড়া রেলওয়ে হাসপাতাল, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা এলাকার সাবু মিয়া, একই জেলার বালাআটা গ্রামের আতিয়া বেগম, আতিয়ার রহমান, পাবনার বেলকুচি এলাকার রেল কর্মচারী আজিবর রহমান আসিব, গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটী গ্রামের সবুজ মিয়া, বগুড়া জেলার মারা গ্রামের আমিনুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম জেলার পশ্চিম রাজগ্রামের সাবু মিয়া, সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার আজিবর রহমানকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশিশ্লষ্টদের আশঙ্কা। ট্রেনের আহত চালক আবুল খায়ের জানান, কুয়াশা থাকায় দূর থেকে লাইনের পরিস্থিতি বোঝা যায়নি। যার ফলে গাড়ির গতিবেগ স্বাভাবিক রাখা হয়। অন্যদিকে মৃতের পরিচয় ও সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। উদ্ধারকারী দলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা চার। তবে প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ওই দুর্ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

খুলনায় গত মঙ্গলবার রাতে খুলনার যোগীপাশা এলাকায় খুলনাগামী নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস (গোয়ালন্দ মেল হিসেবে পরিচিত) ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এর ফলে রাত দেড়টা থেকে সারাদেশের সাথে খুলনার রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফুলতলা উপজেলার যোগীপাশায় রেললাইনের একাধিক ফিসপ্লেট খুলে ফেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। জিআরপি পুলিশের দাবি, অবরোধকারীরা নাশকতার উদ্দেশ্যে রেললাইনের একাধিক স্থানের ফিসপ্লেট খুলে রাখে। এ কারণে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। তবে এ দুর্ঘটনায় লোকজনের কোনো ক্ষতি হয়নি। ট্রেনটি মঙ্গলবার দুপুরে গোয়ালন্দ থেকে খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। সকালে জামায়াত-শিবির কর্মীরা নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকায় গাছ কেটে সড়কে ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ সময় কয়েকটি ইজিবাইক ভাঙচুর করে এবং ১টিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের শাহতলী স্টেশনের পূর্বপাশে রেললাইনের দুর্বৃত্তরা ফিসপ্লেট খুলে ৭৮ ফুট লাইন উপড়ে ফেলায় মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৪টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে করে চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বুধবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বুধবার রাত ১১টা নাগাদ রেললাইন মেরামত করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে বলে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।

এদিকে চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুরগামী সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেন লাকসাম এসে আবার চট্টগ্রাম ফেরত গেছে।  চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে বুধবার পাঁচটি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অবরোধে রেললাইনে বিভিন্ন স্থানে নাশকতার কারণে ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্টেশন ম্যানেজার সামসুল আলম। তিনি জানান- ঢাকা, সিলেট এবং চাঁদপুর থেকে মঙ্গলবার ছেড়ে আসা ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে পৌঁছায়নি। এ কারণে বুধবার ঢাকাগামী সুবর্ণ, মহানগর প্রভাতী, মহানগর গোধূলি, সিলেটমুখি পাহাড়িকা, চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেসের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। চাঁদপুরে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে চট্টগ্রামে উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন মাঝপথে আটকা পড়েছে। হবিগঞ্জের বাহুবলে রেলওয়ের স্লিপারে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় প্রায় একঘণ্টা ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম সড়কে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিলো। গৌরীপুর জংশন থেকে চট্টগ্রামগামী রেলপথের বোকাইনগর ব্রিজে মঙ্গলবার গভীর রাতে দুর্বৃত্তরা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবরোধকারীদের আগুনে রেলপথের ৬-৭টি স্লিপার পুড়ে যায়। বুধবার সকাল ৭টায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলকর্মীরা ফতুল্লা থানার মাসদাইর বাজার এলাকায় নারায়ণগঞ্জ-কমলাপুর রেললাইন অবরোধ করে। এ সময় তারা রেললাইনে ৩টি স্পটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ দেখায়। এ সময় ১৫-২০টি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

ফেনীতে অবরোধকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষে এক যুবদল নেতা নিহত ও ৪ পুলিশসহ প্রায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ফেনী শহর পুলিশ ফাঁড়ির ওপরে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দু শতাধিক রাউন্ড টিয়ারসেল ও গুলিবর্ষণ করে। প্রতিবাদে আজ সকাল-সন্ধ্যা ফেনীতে হরতালের ডাক দিয়েছে জেলা যুবদল। বুধবার বিকেল ৪টায় জেলা যুবদলের সভাপতি গাজী হাবিবুল্লা মানিকের নেতৃত্বে অবরোধের পক্ষে একটি বিক্ষোভ মিছিল এসএসকে সড়ক হয়ে শহরের প্রধান সড়কে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে দু গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপি সংঘর্ষের এক পর্যায়ে অবরোধকারীরা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও শহর পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালায়। পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ঘণ্টাব্যাপি বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে কনস্টেবল সামছুদ্দিন, মাইন উদ্দিন, সামছুর রহমান, আক্তার হোসেন ও যুবদলকর্মী মামুন, সুমনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধ হয়। আহতদের মধ্যে ৪ পুলিশকে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বাকিরা গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা যায়। নিহত হারুনুর রশিদ হারুন ফরহাদ নগর ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি বলে জানা যায়। কিশোরগঞ্জে অবরোধকারীদের ধাওয়া খেয়ে পিকআপ ভ্যান উল্টে উজ্জ্বল সরকার নামে এক ইটভাটা শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে চালকসহ আরও অন্তত ১০ শ্রমিক। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জ শহরতলীর চৌদ্দশত উত্তরপাড়া এলাকার কাছে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। নিহত উজ্জ্বল ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুরের তারাকান্দা গ্রামের বাসিন্দা।

নবাবগঞ্জ উপজেলায় বিএনপি-পুলিশ ধাওয়া- পাল্টাধাওয়ায় গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক যুবদল নেতা অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় এক ছাত্রদল কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে উপজেলার বাগমারা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জাহাঙ্গীর আলম উপজেলার কলাকোপা গ্রামের কালু খানের ছেলে। কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি হোটেলে গোপন বৈঠককালে পৌর মেয়র ও উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদকসহ ৪৭ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার সময় কোতোয়ালি থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। বেলা সাড়ে ১১টায় বরিশাল বাবুগঞ্জ উপজেলা শ্রমিকদল ও ছাত্রদল বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের সাতমাইল এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ করে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কোকডহরা বাজারে বুধবার দুপুরে অবরোধকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কৃষিবিদ এসএমএ খালিদসহ যুবদল-ছাত্রদলের ৩০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) পেট্রোল বোমা হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে ছাত্রদলের কর্মী-সমর্থকরা। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে তারা এ হামলা চালায়। গাইবান্ধায় গ্রেফতার হওয়া স্বেচ্ছাসেবক দলের সব নেতাকর্মীর মুক্তির দাবিতে পলাশবাড়ীতে আজ অর্ধদিবস হরতাল আহবান করা হয়েছে।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে আজ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অর্ধদিবস হরতাল ডাকা হয়েছে। গাজীপুরে মহানগরীর পূবাইল মীরেরবাজার এলাকায় বুধবার সকালে অবরোধকারীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনসহ ২০ জন গুলিবিদ্ধ এবং অন্তত তিন পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে।